২৩শে আগস্ট ২০১০, অমৃতপুরী
‘‘কোন মালয়ালী ‘ওনাম’ শব্দটি শুনলে তার হৃদয়ে যেন সহস্র বসন্ত ঋতু একসঙ্গে উদিত হয়. পৃথিবীর যে কোন প্রান্তেই সে থাকুক না কেন, ওনামের দিনে তার ছেলেবেলার কথা মনে পড়বে – বাড়ী, বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব,গ্রামের খেলার মাঠ – ইত্যাদির কথা স্বতস্ফূর্ত ভাবে তার মনে পড়বে. কিন্তু অতীতের মধুর স্মৃতির সঙ্গে সঙ্গে ওনামের অন্তর্নিহিত আদর্শের কথা মনে করে বর্তমান জীবনে প্রয়োগ করতে হবে. প্রেম, সুখ ও ভ্রাতৃভাব ছাড়াও ওনাম আমাদের নিঃস্বার্থ ভক্তি, দান, আত্মত্যাগ, আত্মসমর্পণ এবং এই জাতীয় গুণের বিকাশ করার কথা মনে করায়.

‘‘অনেকে মনে করে যে ভগবান বিষ্ণু ধার্মিক রাজা মহাবলীকে পাতালে ঠেলে দিয়েছিলেন. তা যদি সত্য হয়, তবে তিরু ওনামের দিনে আমরা মহাবলীর সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ণু ঠাকুরকেও কেন স্বাগত জানাই? বাস্তবে, বিষ্ণুঠাকুর মহাবলীকে নীচে ঠেলে দেননি, তিনি তাকে টেনে তুলেছিলেন আদর্শ স্তরে. শুধু তাই নয়, তিরু ওনামের দিনে সর্বব্যাপী বিষ্ণু চৈতন্য বামন অবতার হয়ে ধরায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন. এই দিনে আমরা মহাবলী এবং বিষ্ণুঠাকুরকে আমাদের বাড়ীতে এবং হৃদয়ে স্বাগত জানাই. তার মানে হল ঈশ্বরভক্তিকে এবং সমস্ত মানবজাতির প্রতি প্রেমভাবকে স্বাগত জানানো. আমাদের মধ্যে ধর্মভাব জাগরিত করতে হবে এবং ঈশ্বরের কৃপালাভের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে. জীবনে সফল হতে গেলে এগুলি অপরিহার্য. মহাবলীর কাহিনী নিজের সমস্ত জয়-পরাজয় এবং ধন-সম্পদ ঠাকুরকে অর্পণ করে শুদ্ধ চৈতন্যের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়ার কাহিনী.

‘‘ওনামের মত বার্ষিক উত্‌সব আমাদের এই প্রেম নতুন করে জাগাতে সাহায্য করে. ওনামের মত দিনে আমরা নিজের সৃষ্ট স্বার্থপরতার কারাগার থেকে নিজেকে মুক্ত করে বাইরের মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারি. এই স্বাধীনতার আনন্দ আমরা ওনামের দিনে অনুভব করি.

‘‘আজকের ওনাম আমাদের ছেলেবেলার ওনাম থেকে একেবারে আলাদা. প্রথামত ওনাম ফুল, প্রজাপতি ও ফড়িং বাতাসে নেচে উঠত, কলাপাতা এবং পুকলম (ফুল দিয়ে মেঝেতে বানানো ডিজাইন) আগেকার মত আজ আর ওনামের আবশ্যিক অঙ্গ নয়. ঢেঁকিতে ধান ভানা, বাচ্চাদের ফুল খঁুজে বেড়ানো, তাদের আনন্দ ধ্বনি, বাচ্চাদের মাঠে দৌড়োদৌড়ি করা এবং ওনামের দিনের বিশেষ খেলা করা – এসব আজ খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়. মাটি, জল এবং ধরিত্রীকে আমরা প্রদূষিত করে আমাদের যন্ত্রণা আরও বাড়িয়েছি.

সংস্কৃত তো আমরা আগেই ত্যাগ করেছি, আর এখন আমরা নিজের মাতৃভাষাও ত্যাগ করতে বসেছি. শুদ্ধ মালয়ালম এবং সঠিক মালয়ালম ব্যাকরণও আমরা ভুলেছি. তা ছাড়া, এমন এক নতুন প্রজন্মের সৃষ্টি হয়েছে যারা ঠিকমত মালয়ালম পড়তে লিখতে বা বলতে জানে না. তাদের মা-বাবা এ জন্য গর্বিত বোধ করে. আমাদের অরিজিনাল শিল্প ও খেলাধুলা যা মানুষের হৃদয়কে পারস্পরিক বন্ধনে আবদ্ধ করত এবং লোকেদের ঈশ্বরের স্মরণ করতে সাহায্য করত, সে সবও হারিয়ে যাচ্ছে. হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের মিলন এবং পারস্পরিক আদান-প্রদানের আনন্দ দিনের পর দিন কম হয়ে যাচ্ছে.
সংক্ষেপে, আজকের মালয়ালীর ওনাম আত্মাবিহীন ওনাম. তা সত্ত্বেও, ওনাম এবং তার স্মৃতি মনে জাগে, মরুভূমিতে বৃষ্টির মত, আমাদের মনে আশা জাগায়. সেই সঙ্গে মনে একটু বিষাদের ছায়াও পড়ে. আসলে, ওনাম আমাদের স্বাভাবিক এবং অকৃত্রিম জীবন পদ্ধতিতে ফিরে যাবার ডাক. আমাদের সংস্কৃতির পুনরুদ্ধারের ডাক.

যেমন করে গাছপালা নিজের অন্তর থেকে ফুলের জন্ম দেয়, তেমনি করে আমাদেরও অন্তরের সদ্ভাব জাগাতে হবে. আমাদের হৃদয়ে অন্যদের জন্যেও স্থান দিতে হবে. আকাশ ও ধরিত্রী জুড়ে যে দৈব সত্তা ব্যাপ্ত হয়ে আছে, তার কাছে আমাদের মাথা নত করতে হবে. এমনি করে সকলে মিলে প্রতিটি দিনকে আমাদের ওনামের মত করে তুলতে হবে. আমার সন্তানদের মধ্যে এটা করার শক্তি যেন থাকে. ঈশ্বরের কৃপা সবার উপরে বর্ষিত হোক.’’