বাছারা, নবরাত্রি ব্রহ্মাণ্ডের আদি কারণ পরাশক্তির পূজার সময়।
নবরাত্রি ব্রত, কৃচ্ছ্রসাধন এবং পূজার সময়। পূজার ধরণ ধারণ স্থান হিসাবে পরিবর্তিত হয়। কোন কোন জায়গায় এক এক দিনে দেবীর এক এক রূপের পূজা করা হয়। প্রথম তিনদিন তাঁকে কালী বা দুর্গা রূপে পূজা করা হয়, পরের তিনদিন লক্ষ্মীরূপে এবং শেষের তিনদিন সরস্বতীরূপে পূজা করা হয়। আবার অন্য অনেক জায়গায় শুধু শেষ তিনদিনে পূজা করা হয়।
অতিরিক্ত নিদ্রাভাব, আলস্য, কাম, ক্রোধ, দর্প, ঈর্ষা, অধৈর্য এবং বিশ্বাসহীনতার মত নেতিবাচক দোষগুলি আধ্যাত্মিক সাধনার পথে উন্নতিতে বাধা দেয়। কৃচ্ছ্রসাধন করে এগুলিকে জয় করা এবং আধ্যাত্মিক পূর্ণতা লাভ করা – এই হল নবরাত্রি পূজার অন্তর্নিহিত আদর্শ। শুধু তাই নয়, প্রার্থনার মাধ্যমে আমরা শক্তি, মঙ্গলময়তা এবং জ্ঞান অর্জন করি। ব্রত পালনের মাধ্যমে আমরা ইচ্ছাশক্তি বৃদ্ধি করতে পারি এবং অধিকতর আত্মনিযন্ত্রণ লাভ করতে পারি। বিজয়াদশমী এই উত্সবের সফল সমাপ্তি সূচিত করে। দুর্গাষ্টমীর দিনে আমরা পুস্তক এবং যন্ত্রপাতি পূজার জন্যে রাখি। এর অর্থ হল বিগত বছরে যে আশীর্বাদ আমরা লাভ করেছি তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। পূজার জন্য দরজি তার সূঁচ রাখে, যোদ্ধা রাখে তার বন্দুক। সেইরকম, ডাক্তার বা কসাই তার নিজের নিজের যন্ত্রপাতি রাখে। তার কারণ এইসব যন্ত্রের সাহায্যে তারা উপার্জন করতে পারে। এই যন্ত্রপাতি ঈশ্বরের সামনে রেখে তারা শপথ নিচ্ছে যে সমস্ত কর্ম তারা পূজা হিসাবে করবে।
পূজার পর সেগুলি আমরা প্রসাদ হিসাবে গ্রহণ করি এবং নতুন করে জীবন শুরু করি। যে কোন মহান কার্য আরম্ভ করার জন্য বিজয়াদশমী মঙ্গলময় মুহূর্ত। এইদিন আমরা বাচ্চাদের হাতেখড়ি দিই (কেরলে এইদিন হাতেখড়ি দেওযার প্রথা, আর বঙ্গে হাতেখড়ি দেওযা হয সরস্বতী পূজার দিনে অর্থাত্ বসন্ত-পঞ্চমীতে) – তাদের লেখাই হরিশ্রী… মন্ত্রটি হল, ওঁ হরিঃ শ্রী গণপতয়ে নমঃ – সমস্ত বর্ণমালার প্রতীক এটি। মানবজাতি প্রধানত বর্ণমালার মাধ্যমে জ্ঞান আহরণ করে। ভাষার মূর্ত রূপ দেবী যখন মন এবং জিহ্বাগ্রে অধিষ্ঠিত হন, তখন মূক বাচাল হয় এবং নিরক্ষর হয় বিদ্বান।
চরম সত্য শুদ্ধ চৈতন্য। তার মধ্য থেকে যখন ব্রহ্মাণ্ড ব্যক্ত হয় তাতে শুদ্ধ চৈতন্যের মধ্যে কোন পরিবর্তন হয়না। এই ক্রিয়ার পশ্চাতে যে শক্তি কাজ করে, তাঁকেই আমরা দেবী বলি। ভগবান এবং তাঁর শক্তি আলাদা নয়; তাঁরা একই – যেমন সূর্য এবং তার আলো, মধু ও তার মিষ্টতা এবং একটি শব্দ ও তার অর্থ একই।
ঈশ্বরকে আমরা ইচ্ছামত যেকোন রূপে পূজা করতে পারি। তাঁকে আমরা মাতা, পিতা, গুরু, সখা, প্রভু বা আমাদের সন্তান ভাবেও পূজা করতে পারি। শুধু একটা জিনিস নিশ্চিত করতে হবে, আমাদের পূজা যেন আধ্যাত্মিক ভিত্তির উপরে স্থাপিত হয়। মানুষের পারস্পরিক সম্বন্ধের মধ্যে সর্বোচ্চ হল মা এবং শিশুর সম্পর্ক। মায়ের কাছে শিশুর অবাধ স্বাধীনতা। কান্নাকাটি করে বা জিদ ধরে সে যা চায়, তা পায়। মা যদি শিশুকে চড়-চাপড়ও লাগায়, শিশু কিন্তু তখনও মাকেই আঁকড়ে ধরে। মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই, – এই হল শিশুর মনোভাব। তার কষ্টের কারণ যাই হোকনা কেন, মায়ের কোলে তার শান্তি। ঈশ্বরের প্রতি আমাদের মনোভাবও এইরকম হওয়া চাই। মা হলেন ধৈর্যের প্রতিমূর্তি। শিশু যতবারই ভুল করুক না কেন, মা বারবার তাকে ক্ষমা করেন এবং স্নেহ-মমতায় ভরে দেন। বেশীরভাগ মায়ের এরকম স্নেহ শুধু নিজের সন্তানের জন্য দেখা যায়, কিন্তু দেবী-মায়ের মনোভাবে ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত প্রাণীর প্রতি প্রেম এবং আধ্যাত্মিক অনুশাসন – এই দুয়ের সমন্বয়।
কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, দেবীকে আমরা মায়া বলি কেন। মায়া কি আমাদের মোহ, দুঃখ এবং বন্ধনের কারণ নয়? তাহলে আমরা দেবীর পূজা করি কেন? ব্রহ্মাণ্ড দেবীর মূর্ত রূপ। সমস্ত রূপে তিনি বিরাজিতা। যেহেতু তিনি সবকিছু, মায়াও দেবীই। দেবী মায়া এবং মায়াবী উভযকেই মোহ থেকে মুক্ত করেন। দেবী জ্ঞান এবং অজ্ঞান। জ্ঞান আমাদের সত্যে নিযে যায়। অজ্ঞান আমাদের অসত্য এবং দুঃখে ঠেলে দেয়। যেহেতু দেবী সবকিছু, তিনি জ্ঞান ও অজ্ঞান উভয়ই, আবার তিনি চরম সত্যও বটে যা জ্ঞান-অজ্ঞানের আধার। মায়া আমাদের নিজের মন ছাড়া আর কিছু নয়। এটা বাইরের কোন শক্তি নয়। মায়া মনের মূলরূপ। বন্ধন এবং মুক্তি – উভয়ের কারণ মন।
একবার কযেজন ডাকাত একটা লোকের মূল্যবান জিনিসপত্র সব কেড়ে নিয়ে তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে একটা কুয়োর মধ্যে ফেলে দিয়ে চলে গেল। লোকটা সাহায্যের জন্যে চিত্কার করতে লাগল। তার চিত্কার শুনে কয়েকজন কুয়োর কাছে গেল। তাকে দেখে তারা একটা দড়ি ছুঁড়ে দিল এবং তাকে টেনে উপরে তুলল। একটা দড়িতে সে বাঁধা পড়ল। পরে আর একটা দড়ি তাকে উদ্ধার করল। সেইরকম, শুধু মনই বন্ধন এবং মুক্তি – উভয়ের কারণ। আমরা চাবি বাঁ দিকে ঘুরিয়ে তালা লাগাতে পারি, আবার ডানদিকে ঘুরিয়ে তালা খুলতে পারি। কিন্তু চাবিটা একই। সেটা আমরা কিভাবে ব্যবহার করব তার উপর নির্ভর করে আমরা দরজাটা খুলতে পারি কিনা। সেইরকম, শুধু মনই বন্ধন এবং মুক্তি দুটোরই কারণ।
আমাদের বেশীরভাগ দুঃখ ভুল ধারণার বশে হয়। সন্ধ্যাবেলা সূর্য সমুদ্রে ডুবে যায়। সেটা দেখে শিশু ভাবে সমুদ্র জলে ডুবে যাচ্ছে এবং কাঁদে। আমাদের বেশীরভাগ দুঃখও এইরকম। ভগবান ব্রহ্মাণ্ডে প্রত্যেকটি জিনিসের নির্দিষ্ট স্থান করে দিয়েছেন। এর মধ্যে বড়-ছোট নেই। সকলের মধ্যে ভগবানকে দেখে সম্মান প্রদর্শন করবে। এই সমদৃষ্টি আমাদের চাই। নবরাত্রির সময় যে বোম্মাকোলু (থাকে থাকে সাজানো মূর্তি – কেরলের প্রথা) সাজানো হয় তার অন্তর্নিহিত তত্ত্বও এটি। বোম্মাকোলুর অতি নগণ্য মূর্তিকেও দেবীর অংশ হিসাবে আমরা পূজো করি। পরাভক্তি হল সবকিছুর মধ্যে ব্রহ্মাণ্ডের জননীকে দেখে সপ্রেমে তাদের সেবা করা এবং পূজা করা।
অন্তর থেকে সঠিক জ্ঞান আমাদের জাগিয়ে তুলতে হবে। আমাদের শাস্ত্রজ্ঞান চাই এবং সেইসব উপদেশ জীবনে পালন করতে হবে। নবরাত্রি যেন আমার সমস্ত সন্তানদের মধ্যে এই মনোভাব জাগিয়ে তোলে। ঈশ্বরের কৃপা তোমাদের সকলের উপর বর্ষিত হোক!