১২ই মার্চ ২০১৭, অমৃতপুরী আশ্রম

প্রশ্ন: আম্মা, আমি শুনেছি যে আত্মজ্ঞানী গুরুগণ নিজেদের দেহরক্ষার জন্য কছু কর্ম করেন। আপনি দেহরক্ষার জন্য কী করেন?

আম্মা: আত্মজ্ঞানলাভ এবং দেহের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই। নিজেকে জানার অর্থ হল অন্যদের মধ্যে নিজেকে দেখতে পাওয়া, তাদের সুখ তোমার নিজের সুখ এবং তাদের দুঃখকে নিজের দুঃখ বলে বোধ করতে পারা। তোমার চোখে আঙুলের খোঁচা লেগে গেলে, তুমি আঙুল এবং চোখ – দুটিকেই সান্ত্বনা দাও; মনের ভাব এরকম হবে।

সকলের ভুল ক্ষমা করে দেওয়া এবং সকলকে ভালবাসা – এই হল আত্মজ্ঞানলাভ। অন্যদের সুখ-দুঃখকে নিজের মনে করা, প্রেম ও করুণা সহকারে ক্ষমা করে দেওয়া – এই হল আত্মজ্ঞানলাভের অবস্থা। আয়না যেমন নির্লিপ্ত হযে প্রতিফলিত করে, অনাসক্ত হয়ে অন্যদের আবেগ তুমি অনুভব কর। তোমার থেকে আলাদা কেউ নেই, যেমন হাজারটা জলভরা পাত্রে সূর্যের প্রতিফলন দেখা গেলেও সূর্য একটাই।

স্বীকৃতি ও বৈরাগ্য

যাঁদের আত্মজ্ঞান লাভ হয়েছে, তাঁদের মধ্যে স্বীকৃতির মনোভাব থাকবে। তাঁরা সংসারের প্রকৃতি জানেন, যেমন সমুদ্রে ভাসমান নৌকোর মত; নৌকো জলের মধ্যে রয়েছে কিন্তু জল নৌকোর মধ্যে নেই। তাঁরা সংসারে বাস করলেও সংসার তাঁদের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না। তাঁরা সংসারে কর্ম করলেও, সে কর্ম তাঁদের বন্ধনের কারণ হয না; তাঁরা সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্ত।

দেহ ও মন

দেহরক্ষার জন্য অন্যদের মত তাঁকেও খাবার খেতে হয়, কিন্তু আত্মজ্ঞানী গুরুর মন একেবারে আলাদা। খাবারের ব্যাপারে মহাত্মাগণ অজগরের মত সপ্তাহে একবার বা দুবার খেয়ে থাকতে পারেন। দেহে যখন বাস করছেন তখন খাবার চাই, কিন্তু কী খাচ্ছেন তার কোন গুরুত্ব নেই। মন কীরকম, সেটা দেখতে হবে। কুলী মাথায মোট বয় আর বৈজ্ঞানিক মাথা ব্যবহার করে নতুন বৈজ্ঞানিক সত্য আবিষ্কার করেন। সেইরকম, আত্মজ্ঞানীর দেহ অন্যদের মত দেখতে হলেও, তাঁরা মনকে একেবারে অন্যভাবে ব্যবহার করেন।

আধ্যাত্মিক মন এবং সাধারণ মন

সাধারণ মানুষ ১০ বা ২০ ওয়াট বাল্বের মত, কিন্তু সাধক হল ট্রান্সফর্মারের মত। মন যখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে, তখন তার শক্তি ক্ষয় হয়। যেমন নদীর বহুমুখী ধারাকে এক পথে চালিত করলে তা তড়িত্ শক্তি উত্পন্ন করার শক্তি ও ক্ষমতা অর্জন করে। যেরকম, আতস কাচ দিযে সূর্যের রশ্মি একত্রিত করলে তা দিযে আগুন ধরানো যায়। সাধারণ মানুষ এবং সাধকের পার্থক্য হল কে কতটা মন একাগ্র করতে পারে।

একইভাবে, আমরা ভিন্ন ভিন্ন তাপমাত্রের জলের নমুনার কথা ধরতে পারি। আমরা বুঝতে পারি যে ফুটন্ত জলে কোনরকম বীজানু থাকতে পারে না, কিন্তু কম তাপমাত্রার জলে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় ময়লা থাকতে পারে। আবার নোনা জল, পরিষ্কার জল এবং ফিল্টার করা জলের কথাও ধরা যেতে পারে। এগুলি সবই জল, কিন্তু তাদের গুণমান থেকে পার্থক্য বোঝা যায়।

মহাত্মার সান্নিধ্যের সদ্ব্যবহার

ধৈর্যের বিকাশ করে মহাত্মার সান্নিধ্য উপভোগ করা উচিত। মহাত্মার স্পর্শ, চিন্তা এবং দৃষ্টিপাত সমগ্র পৃথিবীর কল্যাণ করতে সমর্থ, যেমন মুরগী স্পর্শ করে ডিমে তা দেয়, মাছ দৃষ্টিপাত করে ডিমে তা দেয় আর কচ্ছপ তীরে বালিতে রাখা ডিমে তা দেয় চিন্তার দ্বারা। আমাদের নিঃস্বার্থ কর্ম এবং বিনীত মনোভাব দিয়ে আমরা মহাত্মাকে তুষ্ট করতে পারি।

মহাত্মাগণ নদীর মত – কোনরকম প্রচেষ্টা না করে অনবরত বয়ে যান। নদীর তীরে তোমরা যদি গর্ত খোঁড়, তবে নদীর জল তাতে বয়ে যাবে। আমরা বিনীত হলে মহাত্মাগণ আমাদের দিকে বয়ে আসবেন এবং আমাদের কৃপাপূর্ণ করবেন। মহাত্মার সান্নিধ্য উপভোগ করতে হলে আমাদের হৃদয় খুলে রাখতে হবে, তবেই আমরা তাঁদের সান্নিধ্য উপভোগ করতে পারব।

মহাত্মার কর্ম এবং দেহ

মহাত্মার কাছে সবকিছুই ব্রহ্ম। শুকনো ফুলের মত দেহ একদিন অবধারিত ভাবে ঝরে পড়বে। দেহের প্রতি মহাত্মার কোন মায়া নেই। বাস্তবে, পাওয়ারও কিছু নেই, খোয়াবারও কিছু নেই। এ হল সূর্যের মত; যদিও আমরা সূর্যকে উঠতে এবং ডুবতে দেখি, বাস্তবে সূর্য কখনও ওঠে না বা ডোবে না, সে সর্বদা আলোক বিকিরণ করে। আত্মাও এইরকম। আত্মা অপরিবর্তনশীল। চুম্বকের সান্নিধ্যে লোহাচুর যেমন নড়াচড়া করে, আত্মা হল চুম্বক – নড়াচড়া করে না, যদিও মহাত্মার শরীর নড়াচড়া করতে পারে। মহাত্মার সমস্ত কর্ম জগতের উদ্দেশ্যে।

মহাত্মা শুকনো চীনেবাদাম বা নারকেলের মত – খোলার সঙ্গে আটকানো থাকে না। মহাত্মার কাছে তাঁর দেহও সেইরকম। ইচ্ছামাত্র তাঁরা সাপের খোলস ছাড়ার মত দেহ ছেড়ে যেতে পারেন। কিন্তু তাঁরা সংসারের কল্যাণের জন্য দেহ বজায় রাখেন। তাঁদের সমস্ত কর্ম ধর্ম রক্ষার্থে হয়।

বর্তমানে লোকেরা বেদান্ত দর্শন নিযে তর্ক করতে ভালবাসে, কিন্তু সেই অনুসারে জীবন যাপন করতে চায় না।