প্রকৃতির প্রতি করুণা প্রদর্শন কর, মনকে নিত্য উত্সাহপূর্ণ কর।
১লা জানুয়ারি, ২০১৪, অমৃতপুরী

আমরা আবার একটি নতুন বছরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছি। নববর্ষের কথা মনে হলেই প্রত্যাশা, সুখ এবং উত্সবের আমেজ আসে। সুখ ও শান্তির ফুল আমার সন্তানদের হৃদয়ে ফুটে উঠুক। এইসব ফুলের সুগন্ধ তোমাদের সত্কর্মের মধ্য দিয়ে সারা পৃথিবীতে ব্যপ্ত হোক।

গত একবছরে অনেক ঘটনা আমাদের মনে গভীর আঘাত সৃষ্টি করেছে। যুদ্ধ, সংঘাত, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, নারী নির্যাতন… তালিকা শেষ আর হয় না। সিরিয়াতে যুদ্ধ, ফিলিপাইন্স-এ হারিকেন, উত্তরাখণ্ডে ধ্বংসলীলা – এইসব মর্মান্তিক ঘটনার ছবি আমাদের মনে ক্রমাগত উদয় হতে থাকে। মানবজাতির সামনে বর্তমানে যেসব প্রতিস্পর্দ্ধা রয়েছে সেগুলি নিয়ে সেগুলি নিয়ে আমরা বিস্তর আলোচনা এবং লেখালেখি করেছি, কিন্তু এখনও আমরা সেগুলি সম্বন্ধে সত্যি সত্যি জাগরূক নই। পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে অনেক লোক প্রচুর কথা বলে, কিন্তু সেইসব আদর্শগুলি বাস্তবে পালন করলে তবে মহানতার পরিচয় পাওয়া যায়। গত এক বছরে আমরা ১ কোটি ২৫ লক্ষ একর জঙ্গল ধ্বংস করেছি। এত বিশাল জঙ্গল সৄষ্টি করতে গেলে কত বছর লাগবে? সেটা কি আদৌ করা সম্ভব? বৈজ্ঞানিকরা বলে জঙ্গলগুলি আমাদের গ্রহের ফুসফুস। আমাদের এমন জাগরূকতা দরকার যে নদী, সমুদ্র এবং জঙ্গলে দূষণ ছড়ানো আমাদের রক্তে বিষের ইঞ্জেকশান দেওয়া থেকে আলাদা কিছু নয়। যে মানুষের প্রকৃতিকে রক্ষা করার কথা, সেই মানুষই তার ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আম্মার একটি অনুরোধ আছে : নববর্ষের সংকল্প গ্রহণ করার সময় আমাদের সংকল্প করতে হবে যে আমরা প্রকৃতির প্রতি করুণা প্রদর্শন করব। প্রকৃতির সংরক্ষণের জন্য আমরা যত সামান্য কর্মই করিনা কেন সেটা মূল্যবান কারণ সেটা আসলে জীবনধারণে সাহায্য করে। যেকোন বস্তুতান্ত্রিক সম্পদের তুলনায় সেটা অনেক বেশী মূল্যবান। স্কুলের মাধ্যমে আমরা বাচ্চাদের মধ্যে পরিবেশ সম্বন্ধে উত্সাহ জাগিয়ে তুলতে পারে, যেমন আমরা অর্থ উপার্জনের জন্য তাদের মধ্যে উত্সাহ জাগিয়ে তুলি।

শুধুমাত্র ক্যালেণ্ডারের পাতা ওল্টালে কোনকিছুর পরিবর্তন হবে না। আমাদের অন্তরের কাম, ক্রোধ, ঈর্ষারূপ অপবিত্রতা সুসময়কে দুঃসময়ে পরিণত করবে। আমাদের জীবনের কিছু উচ্চ লক্ষ্য থাকা প্রয়োজন। কল্পনা কর সমুদ্রে একটা জাহাজ যাচ্ছে এবং তার পাল হাওয়া ধরার মত ঠিক করে লাগানো আছে। কিন্তু জাহাজের কাপ্তেন যদি না জানে সে কোন বন্দরে নোঙর করবে, তবে সে শুধু জাহাজ চালনা করতে থাকবে। গন্তব্যস্থল না থাকলে জাহাজ যত ভাল ভাবে চালানো হোকনা কেন, তা অর্থহীন। লক্ষ্য আমাদের উত্সাহ, বল এবং কর্মশক্তি প্রদান করে। সেগুলি আমাদের প্রাণবন্ত করে।

লক্ষ্যের দিকে এগোতে হলে আমাদের রোজকার কর্মসূচি চাই। আধ্যাত্মিকতা যদি আমাদের লক্ষ্য হয় তবে আমরা সত্ চিন্তা লালন পালন করব। আমরা সত্কর্ম করার চেষ্টা করব। অযথা চিন্তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাব না। অপরের সাফল্য দেখে আমরা ঈর্ষা বোধ করব না। আমাদের আশেপাশে কি হচ্ছে তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাব না; আমরা শুধু যতটা পারি, করব। আমরা আধ্যাত্মিক পুস্তক পড়ব এবং সত্সঙ্গে যোগ দেব।
মৃত্যু অনবরত ছায়ার মত আমাদের সামনে-পিছনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের দেহ হল ভাড়াবাড়ীর মত। যে কোন মুহূর্তে আমাদের সেটা ছেড়ে যেতে বলা হতে পারে। হাত-পা ছুঁড়ে চেঁচামেচি না করে আনন্দের সঙ্গে আমাদের ছেড়ে যাওয়ার জন্য তৈরী থাকা উচিত। মৃত্যু আমাদের অধিকার করার আগে আমাদের অনেক জরুরী কাজ সম্পন্ন করতে হবে। জীবন আমাদের পিছন ফিরে দেখার সুযোগ দেয় এবং সেই সঙ্গে আমাদের সামনে চেয়ে কর্মে মনোযোগ দেবার সুযোগও দেয়। আমরা জীবনপথের যাত্রা কেন আরম্ভ করেছি? আমাদের লক্ষ্য কী? আমরা কি ঠিক পথে এগোচ্ছি? না আমরা পথ হারিয়েছি? নববর্ষের ঊষাকাল আত্মসমীক্ষণ এবং সংকল্প করার সময়।

পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার জন্য আমরা রোজ স্নান করি। উত্সাহ হল মনের স্নান। শুধু নববর্ষের দিনে উত্সাহ এবং আনন্দ বোধ করা কোন কাজের কথা নয়। এই অনুভতি সারা বছর আমাদের জাগিয়ে রাখতে হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা মুখ হাত ধুয়ে দিনের প্রস্তুতি আরম্ভ করি। কেউ নিজেকে কুত্সিত্ দেখাতে চায় না। সাধারণত দিনের আরম্ভে আমাদের মনে এই চিন্তা থাকে। কিন্তু আমাদের মনকেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা দরকার। মন থেকে নেতিবাচকতার ধুলোবালি মুছে ফেলতে হবে। তাহলে শুধু আমাদের জীবন নয়, আমাদের আশেপাশে যারা আছে তাদের জীবনও সুন্দর হয়ে উঠবে। এরকম মনোভাব যদি আমাদের মধ্যে থাকে, তবে সমস্ত জগত্ ঝলমল করে উঠবে যেন নব বসন্তের আগমন হয়েছে।

 

আম্মার সন্তানেরা প্রেম ও শান্তির দূত হয়ে উঠুক। আম্মার প্রার্থনা এই যে তার সব সন্তান সুখ-শান্তিতে পরিপূর্ণ হোক। সকলের উপর কৃপা বর্ষিত হোক। এসো আমরা সকলে মিলে উচ্চারণ করি, “ওঁ লোকাঃ সমস্তাঃ সুখিনো ভবন্তু॥” সর্বলোকে সবই প্রাণী সুখী হোক! অন্ধকার দূর করা কঠিন, কিন্তু আলোকের উপস্থিতিতে অন্ধকার স্বতস্ফূর্ত ভাবে দূর হয়ে যায়। সেরকম, আম্মার সব সন্তানের হৃদয়ে প্রেম ও করুণার প্রদীপ উজ্জ্বল হয়ে উঠুক। পরমাত্মা আমাদের সকলকে শক্তি প্রদান করুন!