নিউ ইয়র্কে ইউনাইটেড নেশন্স অ্যাকাডেমিক ইম্প্যাক্ট – বজায়-সম্ভাব্য বিকাশ বিষয়ক কনফারেন্সে অমৃতা ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলার হিসাবে আম্মার কি-নোট ভাষণ। নিউ ইয়র্ক, ৮ই জুলাই ২০১৫

উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তিসকলকে আমার নমস্কার জানাই। এই সুযোগে এই সম্মেলন আয়োজিত করার জন্য আমি রাষ্ট্রসংঘের অ্যাকাডেমিক ইম্প্যাক্টকে হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা জানাই। রাষ্ট্রসংঘ ঐক্য সূচিত করে।
আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ ভাবতে পারেন, আম্মার মত আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ এখানে কী করবে? আধ্যাত্মিক জ্ঞানের প্রাসঙ্গিকতার উপর আমার বিশ্বাস আমাকে এখানে আপনাদের সামনে নিয়ে এসেছে। আমি প্রায়ই পৃথিবী, প্রকৃতি-সংরক্ষণ এবং মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাব নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করি। এই চিন্তনের ফলে আমার মধ্যে এই বিশ্বাসের জন্ম হয়েছে যে বিজ্ঞান, টেকনোলজি এবং আধ্যাত্মিকতা – এই তিনের ঐক্য প্রয়োজন যাতে আমরা পৃথিবীর বজায়-সম্ভাব্য এবং ভারসাম্য সম্মত বিকাশ করতে পারি। বর্তমান যুগ এবং পৃথিবী আমাদের নিকট এই আমূল পরিবর্তন দাবী করে।

দিনের পর দিন বিজ্ঞান ও টেকনোলজি অনিয়ন্ত্রিত ভাবে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বৃদ্ধি আমাদের কোথায় নিয়ে চলেছে, কেউ জানে না। আমরা চারদিকে তাকালে দেখতে পাই ডেভলপার্স, নির্মাতা, বিতরণকারী এবং ক্রেতাগণ সর্বাধুনিক, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে বড় জিনিসের পিছনে পাগলের মত ছুটছে। মানবজাতির বর্তমান অবস্থা হল বাচ্চাকে চকলেটের দোকানে ছেড়ে দেবার মত।

আজ আমরা বিছানায় শুয়ে শুয়ে যে কোন খাবার, দেখার বা শোনার জিনিস অর্ডার করতে পারি এবং সেটা আমাদের দরজায় পৌঁছে যাবে। নতুন বা পুরোন কোন জিনিস কেনার জন্য আজ আমাদের বাইরে দোকানে যেতে হয় না। সবরকম জিনিসের জন্য ওয়েবসাইট আছে। ইন্টারনেট জগতে বিপ্লব নিয়ে এসেছে যেটা ভাল কথা। এখন আমরা আঙুলে ক্লিক করে যে কোন জিনিস কিনতে পারি, একটি জিনিস ছাড়া – সে হল প্রেম।

আজ আমাদের এয়ারকণ্ডিশন, বাড়ী, গাড়ী এবং অফিস আছে। কিন্তু অনেকে তাদের এয়ারকণ্ডিশন ঘরেও ঘুমাতে পারে না এবং তার জন্য তাদের ঘুমের বড়ি খেতে হয়। কেউ কেউ এয়ারকণ্ডিশন বাড়ীতে আত্মহত্যা করে। এসবের অর্থ কী? শুধুমাত্র বাইরের আরাম থেকে আমরা মনের শান্তি লাভ করতে পারি না। সে জন্যে আমাদের মনকে এয়ারকণ্ডিশন করতে হবে। সে ব্যাপারে আধ্যাত্মিকতা সাহায্য করতে পারে।

আমরা বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে বাস করি। এই গ্রহের যেখানেই আমরা যাইনা কেন, আমাদের ইন্টারনেট চাই। কিন্তু ইন্টারনেট কানেকশানের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ইনার-নেট কানেকশান নতুন করে আবিষ্কার করতে হবে। আধ্যাত্মিকতা আমাদের শেখায় কেমন করে আমাদের অন্তর্জগত এবং বহির্জগত দুটোই ম্যানেজ করতে হয়। যে সাঁতার জানে, তার পক্ষে সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে খেলা করা আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা; কিন্তু যে সাঁতার জানে না, সে মুহূর্তের মধ্যে ডুবে যাবে।

সমাজের কী অবস্থা? জীবনের দ্রুতগতির পাল্লায় পড়ে মানুষ মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলেছে; তাদের গুরুত্ব আমরা তুচ্ছ করে দিই। ব্যক্তিগত স্তর থেকে আন্তর্জাতিক স্তর পর্যন্ত আমরা সবরকম সংঘাত এবং অধার্মিক কর্মের পশ্চাতে যুক্তি খাড়া করতে চাই। তারপর, আমাদের সেই যুক্তি আমরা অবশিষ্ট সমাজের উপরে চাপিয়ে দিই।

অনাদি কাল থেকে পৃথিবীতে নানা সমস্যা রয়েছে। যুগ যুগ ধরে যুদ্ধ, সংঘাত, জাতিভেদ ও সামাজিক মর্য্যাদা জনিত বৈষম্যে এবং পরিবারিক কলহে সমাজ ভুগেছে। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবন সম্বন্ধে অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গী ছিল। অন্তরে তাঁরা তিনটি জিনিস সম্বন্ধে জাগরূক ছিলেন: মানবজাতি, প্রকৃতি এবং এক অদৃশ্য শক্তি যা তাদের সামঞ্জস্যপূর্ণ রূপে ঐক্যবদ্ধ করে রাখে।

জীবন সম্বন্ধে তাঁদের দৃষ্টি শুধুমাত্র ব্যক্তিবিশেষ এবং প্রকৃতির স্থূল অস্তিত্ব হিসাবে ধরত না। তাঁরা বিশ্বাস করতেন এক শক্তি প্রকৃতি এবং সমস্ত জীবের ভিত্তি – এক অদৃশ্য শক্তি যা সমস্ত প্রাণীকে প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত করে। এই শক্তিকে তাঁরা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে করতেন। তাঁরা এও বিশ্বাস করতেন যে সমস্ত প্রকৃতি এবং ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি জীব নানা আকার ও আকৃতির মুক্তোর মত সৃষ্টির একসূত্রে গাঁথা। তাই তাঁরা সকলের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া, পরস্পরের যত্ন নেওয়া এবং সমবেদনা অনুভব করার উপরে এত গুরুত্ব দিতেন। এই মানসিকতাকে আজ আমরা আদিম নাম দিয়েছি এবং তাঁদের জীবনধারণের পদ্ধতিকে বর্জন করেছি।

আধুনিক জীবনের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই প্রাচুর্যে ভরা কিন্তু দুঃখে নিমগ্ন এক সমাজ। অতিরিক্ত লোভ মানবজাতিকে অন্ধ করে তুলেছে এবং তার ফলে অমানবিক কর্ম ক্রমবর্দ্ধমান। মানসিক আলোড়ন এবং চাপ পূর্বে অজানা এবং নতুন অসুখের সৃষ্টি করেছে। মানবজাতি এক সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হয়েছে। বর্তমানে মানবজাতি শুধুমাত্র বিজ্ঞান ও টেকনোলজির উপর নির্ভর করে জীবন যাপন করছে। কিন্তু বর্তমান সময়ের দাবী হিসাবে আমাদের আধ্যাত্মিক চিন্তাধারাও সামিল করা উচিত; অন্তত চেষ্টা করা উচিত।

সম্প্রতি আমরা কত প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং পৃথিবীর পরিবেশে দ্রুতগতি বিশ্ব উষ্ণায়ন সহ ভয়ংকর সব পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। আমাদের গভীর ভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন – পৃথিবীর এই ভয়ংকর পরিণতি রোধে শুধুমাত্র মানুষের প্রচেষ্টা কি পর্য্যাপ্ত হবে!

পুরাতন কালে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে জীবন যাপন করত। তারা কোন গাছ লাগাবার বা কাটবার আগে শুভদিন দেখত। কোন গাছ কাটার আগে তারা গাছটিকে পূজা করত এবং তারপর ক্ষমা চাইত, “যে কাজ আমি করতে যাচ্ছি, তার জন্য আমাকে ক্ষমা কর। নিতান্ত দরকার আছে বলে আমি তোমাকে কাটতে যাচ্ছি।’’ কিন্তু আজকে কী হয়? আমাদের বৃক্ষরোপণ যে বিরল শুধু তা নয়, আমরা নিরন্তর তাদের এবং সমগ্র প্রকৃতিকে ধ্বংস করে ফেলছি।

আম্মা যখন ছোট ছিল, লোকেরা কাটা ঘায়ে গোবর লাগাত। তাতে ঘা দূষিত হত না এবং তাড়াতাড়ি সেরে যেত। কিন্তু আজ যদি আমরা তা করি, তবে সঙ্গে সঙ্গে ঘা দূষিত হয়ে যাবে। যে জিনিস অতীতে ওষুধ ছিল, আজ তা বিষে পরিণত হয়েছে। প্রকৃতি এত দূষিত হয়েছে।

যেমন করে আমরা মাদার্স ডে, ফাদার্স ডে, ভ্যালেন্টাইন ডে এবং থ্যাংক্সগিভিং ডে পালন করি, সেরকম প্রকৃতি মাতাকে সম্মান জানানোর জন্যও একটি দিন ধার্য করা উচিত। সেদিন প্রত্যেকের একটি করে বৃক্ষ রোপণ করা উচিত। সেটিকে নববর্ষের সঙ্গেও যুক্ত করা যেতে পারে যাতে নববর্ষের শুভারম্ভ হয়। তা যদি আমরা করি তবে আমাদের গ্রহ এক স্বর্গে পরিণত হবে। গাছ হল প্রকৃতি মাতার জন্য নির্মিত বাড়ীর মত।

সৃষ্টির প্রতিটি জিনিসের একটি ছন্দ আছে – সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড এবং প্রতিটি প্রাণী এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ; এই সত্য আমরা অস্বীকার করতে পারি না। ব্রহ্মাণ্ড এক বিশাল ইন্টারকানেক্টেড নেটওয়ার্কের মত। ধরা যাক একটি জাল রয়েছে। সেটার এক জায়গায় নাড়ালে পুরো জালের মধ্যে তার স্পন্দন অনুভব করা যাবে। সেইরকম, আমরা জানি অথবা না জানি, আমাদের সমস্ত কর্ম – ব্যক্তি হিসাবে করা হোক বা সমষ্টিগত ভাবে – সমগ্র সৃষ্টিতে স্পন্দনের সৃষ্টি করে। আমরা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত নই, আমরা একই শিকলের এক একটি কড়ি।

যখন মানুষ, প্রকৃতি এবং অতীন্দ্রিয় শক্তি যুগ্ম ভাবে কর্ম করে তখন সামঞ্জস্য বজায় থাকে। কিন্তু বর্তমানে আমরা শুধুমাত্র মানুষ এবং তার আবিষ্কারকে গুরুত্ব দিই। আমাদের জীবনে মূল্যবোধের কোন স্থান নেই। আজকের সাধারণ মানুষ মনে করে এগুলির কোন প্রাসঙ্গিকতা নেই এবং উটকো।

ইঞ্জিন ঠিকমত চলতে হলে তাতে তেল চাই। এই তেল মূল্যবোধের সঙ্গে বিরুদ্ধতা ছাড়া আমাদের জীবন যাপন করতে সাহায্য করে। আধ্যাত্মিক চিন্তন এই মূল্যবোধের বিকাশ করে।

দুরকমের শিক্ষা আছে – জীবন ধারণের শিক্ষা এবং জীবন যাপনের শিক্ষা। আমরা যখন ডাক্তার, উকীল বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য কলেজে পড়ি, সে হল জীবন ধারণের শিক্ষা। অপরদিকে জীবন যাপনের শিক্ষার জন্য আধ্যাত্মিকতার বুনিয়াদী সূত্রগুলি বোঝা দরকার। প্রকৃত শিক্ষার উদ্দেশ্য এই নয় যে শুধু মেশিনের ভাষা বুঝতে পারার জন্য মানুষ তৈরী করা। শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হৃদয়ের সুসংস্কারের বিকাশ করার জন্য হওয়া উচিত – এমন সংস্কার যা দীর্ঘস্থায়ী মূল্যবোধের উপর স্থাপিত।

আধ্যাত্মিকতাও এক বিজ্ঞান – এটাও জ্ঞানের এক শাখা যেটাকে উপেক্ষা করা চলবে না। বৈজ্ঞানিকগণ ভৌতিক জগত নিয়ে গবেষণা করে ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করছেন। বাস্তবে, আধ্যাত্মিক শাস্ত্রসমূহ তাঁদের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছে যাঁরা একই রহস্যের দ্বার উদঘাটনের জন্য অন্তর্জগতে তীব্র অনুসন্ধান করেছেন। যখন শুধুমাত্র অংক, পদার্থবিদ্যা এবং যুক্তি দিয়ে আমরা আধ্যাত্মিকতা বুঝতে চেষ্টা করি, আমরা তার সূক্ষ্মতা বুঝতে ব্যর্থ হতে পারি। সে জগতে আমাদের শিশুর সরলতা নিয়ে প্রবেশ করতে হবে এবং শিশুর মনে ও চোখে যে বিস্ময় দেখা যায়, তা দিয়ে দেখতে হবে। সত্যি বলতে কি, অতীতের অনেক বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক শিশুর বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে সমীহের মনোভাব নিয়ে ব্রহ্মাণ্ড এবং তার সূক্ষ্মতাকে দেখেছেন। তাঁদের গবেষণার পশ্চাতে ছিল সরল শিশুসুলভ কৌতূহল এবং বিশ্বাস সত্যি বলতে কি, অতীত এবং বর্তমানের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আধ্যাত্মিকতার প্রয়োজন স্বীকার করেছেন, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। আম্মা প্রার্থনা করে বর্তমান বৈজ্ঞানিক সমাজ যেন সেই ভুল আবার না করে।

জীবন হল যুক্তি এবং রহস্যের সংমিশ্রণ – হয়তো যুক্তি অপেক্ষা রহস্যের ভাগ বেশী! জীবনের সমস্ত অঙ্গে মস্তিষ্ক এবং হৃদয় একত্রে থাকা দরকার। উদাহরণ হিসাবে, সাদা বালি এবং চিনি মেশানো থাকলে দুটোকে আলাদা করা বেশ মুশকিল – অতি বুদ্ধিমান মানুষের পক্ষেও। কিন্তু, আপাতদৃষ্টিতে অতি তুচ্ছ পিঁপড়ে – বিনয়ের প্রতীক – সহজে তার মধ্য থেকে শুধু চিনিটা খেতে পারে।

আম্মার জন্ম হয়েছিল এক জেলেদের গ্রামে যেখানে ৯০% লোক দিনমজুরী করত। গ্রামের অনেক মানুষের হৃত্পিণ্ডে ভালভের রোগ ছিল। তাদের ভাল্ভের রোগ ধরা পড়লেও তারা অস্ত্রোপচার করাতে পারত না, কারণ ভাল্ভ ইম্পোর্ট করতে হত এবং দাম অত্যন্ত বেশী। সুতরাং, যেসব মানুষ ৭০-৮০ বছর বাঁচতে পারত, তারা মাত্র ৩০ বা ৪০ বছর বয়সেই মারা যেত। আম্মা তখন ভাবত, আমরা যদি কম দামে ভাল্ভ তৈরী করতে পারতাম। এমনি করে আম্মা দরিদ্রদের সাহায্যের জন্য গবেষণা করার কথা ভাবত।
শিশুমৃত্যু বেশীরভাগ দেশে এক মহা সমস্যা। এর কারণ খুঁজতে আমরা ভারতের বহু গ্রামে গিয়েছি। কোন কোন গ্রামে আমরা দেখতে পেতাম যে মেয়েরা শুধু লতাপাতা খেয়ে থাকত। এর কারণ জিজ্ঞেস করাতে তারা উত্তর দিল, আমাদের স্বামীরা দিনমজুরী করে, তাও প্রতি ৩-৪ দিন অন্তর অন্তর কাজ পায়। পয়সার অভাবে আমরা সামান্য খাবার পাই এবং তার পুরোটাই স্বামীদের দিয়ে দিই। খিদে মারার জন্য আমরা কিছু বিশেষ লতাপাতা খাই। পেটে যখন বাচ্চা থাকে, তখনও তাদের খাবার এই। এরকম অপুষ্ট মাতার গর্ভের সন্তান কী করে বাঁচতে পারে?

অন্য কোন গ্রামের কোন কোন মহিলারা বলে, আমাদের স্বামীরা যা রোজগার করে, সব মদ আর অন্য বদভ্যাসে উড়িয়ে দেয়। মাতাল হয়ে বাড়ী আসে আর আমাদের গালাগাল ও মারধর করে। বাড়ীতে পর্যাপ্ত খাবার থাকা সত্ত্বেও আমাদের খেতে ইচ্ছে হয় না।

কোন কোন গ্রামে মেয়েরা নিরক্ষর; তাই তাদের বাড়ীর পুরুষরা তাদের সই জাল করে তাদের প্রাপ্য সরকারী সাহায্য ঠকিয়ে নেয়। তাই আমরা মেয়েদের জন্যে সাক্ষরতা অভিযান আরম্ভ করেছি। হ্যাপ্টিক ডিভাইসের সহায়তায় আমরা এইসব মেয়েদের অর্থকরী বিদ্যা শিক্ষা দেওয়া আরম্ভ করেছি।

যাদের আছে এবং যাদের নেই তাদের মধ্যেকার পার্থক্য আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অভিশাপ এবং এই পার্থক্য দিন দিন বেড়ে চলেছে। একদিকে এক পর্বত এবং অন্য দিকে এক উপত্যকা – বর্তমান পরিস্থিতি এইরকম। একদিকে কিছু লোক কোটি কোটি টাকা বিলাসিতার জন্য খরচ করছে। অপর দিকে, কতলোক কোনরকমে একবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করছে, একদিনের ওষুধ জোগাড় করছে। এই দুয়ের ফাঁক আমরা যদি ভরাট করার চেষ্টা না করি, তবে এর ফল হবে সংঘাত এবং বিস্তৃত দাঙ্গা। এই দুই দলকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য প্রেম ও করুণার সেতু অতি আবশ্যক।

মানবজাতির কলংক দারিদ্র সমস্ত সদ্গুণ এবং প্রতিভা বিনষ্ট করে। এ নৈতিক অবক্ষয়েরও কারণ।

একবার আম্মা যখন বিদেশে এক অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিল, গৃহহীন কিছু শিশু দর্শনের জন্য আসে। তারা নিজেদের আঁকা ছবি আম্মাকে দেখাচ্ছিল। বেশীরভাগ ছবির বিষয় ছিল বোমা, মিসাইল এবং যুদ্ধজাহাজের সংঘাতপূর্ণ ছবি। একটি বাচ্চা যিশু এবং মাদার মেরীর ছবি এঁকেছিল, কিন্তু সে ছবিতে তাঁদের হাতে ছিল বন্দুক। আম্মা যখন সেই ছেলেকে জিজ্ঞেস করল যিশুর হাতে পিস্তল কেন এঁকেছে, সে উত্তর দিল, যখন তাঁর খিদে পাবে, তাঁর কি খাবার দরকার হবে না? তাঁর যদি পিস্তল থাকে তবে তিনি সেটা দেখিয়ে কাউকে লুটতে পারেন।

আম্মা তাকে জিজ্ঞেস করল, বাছা, কাউকে পিস্তল দেখানোটাই কি টাকা রোজগারের একমাত্র রাস্তা?
সে ছেলে উত্তর দিল, আমার বাবা তাই করে।

তোমার বাবা কি চাকরী করে কিছু রোজগার করতে পারে না? আম্মা জিজ্ঞেস করল।
ছেলেটি উত্তর দিল, আমার বাবার স্বাস্থ্য ভাল এবং সে চাকরী করতে পারে। বাবা নানা জায়গায় ইন্টারভিউ দিতেও গিয়েছিল, কিন্তু কেউ তাকে চাকরী দেয়নি। আমাদের মত মানুষকে কেউ চাকরী দেয় না। তাই বাবা পিস্তল হাতে তুলে নিয়েছে। তাই দিয়ে বাবা আমাদের প্রতিপালন করে।

বাচ্চারা যেসব জিনিস বা পরিস্থিতি দেখেছে, তাদের মনে তা গভীর ছাপ ফেলেছে। দারিদ্র এবং তা থেকে যে হীনমন্যতার সৃষ্টি হয় তা খুব কম বয়স থেকেই সংঘাতপূর্ণ মনোভাবের সৃষ্টি করে। এমনি করে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়। এরকম পরিস্থিতিতে প্রেম ও করুণার বিশেষ প্রয়োজন।

অনেক লোক আধ্যাত্মিকতার নাম শুনলেই নাক সিঁটকায়। আধ্যাত্মিকতা কী? সত্যিকারের আধ্যাত্মিকতা হল কর্মে মাধ্যমে করুণার প্রকাশ; এর আরম্ভ করুণা দিয়ে হয় এবং এর শেষও করুণাতেই। আমরা যদি করুণাকে শব্দের পরিবর্তে কর্মধারায় পরিণত করতে পারি তবে ৯০% মানবীয় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

অন্যদের সাহায্য করার প্রথম পদক্ষেপ জাগরূকতার সৃষ্টি করা। নিয়মিত ওষুধ খাওয়া সত্ত্বেও ডায়বেটিসের রোগী যদি নিয়মিত মিষ্টি খেতে থাকে, তবে তার ব্লাড সুগারের স্তর বেড়ে যাবে। সুতরাং, ওষুধের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ এবং জীবনধারার পরিবর্তনও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যে সব গ্রাম আমরা উন্নয়নের জন্যে (অমৃতা সার্ভ বা লিভ-ইন-ল্যাব প্রকল্পের অন্তর্গত) হাতে নিয়েছি, প্রতিটি গ্রামের কিছু মানুষকে আমরা টয়লেট বানানো শিখিয়ে দিলাম এবং নির্মাণের কাজ তাদের হাতে ছেড়ে দিলাম। কিছু সময় পরে আমরা যখন আবার সেসব গ্রামে প্রগতি দেখতে গেলাম, তখন দেখা গেল লোকেরা টয়লেট ব্যবহার করছে না। তারা টয়লেটের দরজা খুলে ভিতরে এমন ভাবে দেখে যেন কোন মন্দিরে গেছে এবং তারপর তারা দরজা বন্ধ করে আগের মত মাঠে যায় কাজ সারতে। তখন আমরা গ্রামের লোকেদের শেখাতে আরম্ভ করলাম যে বাইরে পায়খানা করলে তা জল এবং মাটিকে দূষিত করে; তা থেকে খাবার দূষিত হয় যার ফলে কৃমি, ইত্যাদির মত রোগ হয়। এরপর সমাজে জাগরূকতা আসে।

যাদের আমরা ভালবেসে সেবা করতে চাই, তাদের না বুঝে সেবা করার চেষ্টা করলে প্রায়ই আমরা তাদের এবং নিজেদের ক্ষতি করে বসি। সেবার ফল যাতে কল্যাণকারী হয়, তার সঙ্গে সঙ্গে সদসত্ বিচারেরও বিকাশ করতে হবে। বজায়-সম্ভাব্য বিকাশের (sustainable development)এটিই মূল কথা।

একটা মাছ নদীর মধ্যে খেলছিল। এক বাঁদর জল খেতে এসে মাছটাকে লক্ষ করল। সে ভাবল, বেচারা মাছ, জলের স্রোতে আটকে পড়েছে। ওকে বাঁচাতেই হবে! মুহূর্তের মধ্যে বাঁদরটা মাছের কাছে গিয়ে তাকে জল থেকে ডাঙায় তুলে দিল। মাছটা ডাঙায় খাবি খেতে লাগল এবং কিছুক্ষণের মধ্যে মারা গেল।
মাছটাকে জল থেকে তোলার আগে বাঁদরটা যদি মাছের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করত, তা হলে কী হত? সে যদি জিজ্ঞেস করত, আমি কি তোমাকে জল থেকে তুলে নিয়ে আসি? মাছ উত্তর দিত, আরে, না! তুমি যদি সেরকম কর, তা হলে আমি মরে যাব! পরিস্থিতি না বুঝে কিছু করার চেষ্টা বাঁদরের মাছকে বাঁচাবার চেষ্টা করার মত। আমাদের সমস্ত কর্মে হৃদয়ের সঙ্গে বুদ্ধির যোগ থাকা চাই।

একবার একটি লোক একটি ১০ বছরের ছেলেকে আম্মার কাছে নিয়ে এল। সে চাইছিল আম্মা আশ্রমে তার প্রতিপালন করুক। বাচ্চাটি কেমন করে অনাথ হয়ে যায়, সে কথা লোকটি আম্মাকে শোনায়। ওর বাবা দু বছর আগে মারা যায়। তাই তার মা এবং বোন বাড়ীর কাছে এক মোমবাতির কারখানায় চাকরী করতে যায়। তারপর তার মায়ের ক্রণিক কিডনীর রোগ ধরা পড়ে। সে শয্যাশায়ী হয়ে রইল, আর চাকরী করতে পারত না। তার বোন যদিও সামান্য মাইনে পেত, তাদের কোনরকমে চলে যেত।
তারপর শিশু-শ্রমিক বিরোধী আইন প্রণয়ন হল। মোমবাতির কারখানার মালিককে জেলে ভরে দিল আর তার কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। কারখানার বাচ্চাদের বাড়ী পাঠিয়ে দেওয়া হল। একমাত্র রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে অসহায় মা ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়ে দিল এবং নিজে মেয়েকে নিয়ে বিষ খেয়ে মরে গেল।

এরকম কারখানা বন্ধ করে দেওয়া যুক্তিযুক্ত, কিন্তু আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে ওখানে কর্মরত বাচ্চাদের পরিবার শুধু তাদের রোজগারের উপর নির্ভর করছে। কোন সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আমরা যদি শুধু একটা দিক দেখি এবং অন্য দিক দেখতে ব্যর্থ হই, তবে তার ফল ভোগ করতে হয় সেসব লোকেদের যাদের আর অন্য কোন উপায় নেই।

লোকেরা জিজ্ঞেস করে, আধ্যাত্মিকতার গুরুত্ব কি? আধ্যাত্মিকতা আমাদের এই বিচারবুদ্ধি দেয় কোনটা আবশ্যক এবং কোনটা অত্যধিক। উদাহরণ হিসাবে, সময় দেখার জন্য আমাদের ঘড়ি দরকার। ১০০ ডলারের ঘড়ি এবং ৫০,০০০ ডলারের ঘড়ি সে কাজ করতে পারে। আমরা যদি ১০০ ডলারের ঘড়ি কিনে বাকী টাকা দরিদ্রদের সেবায় লাগাই, তবে সমাজের বিরাট সেবা হবে। আমরা হাজারটা জলভরা পাত্রে হাজারটা সূর্য্যের প্রতিবিম্ব দেখতে পাই, আসলে কিন্তু সূর্য্য একটাই। সেইরকম আমাদের সকলের মধ্যেকার চৈতন্য একই। এরকম মনোভাবের বিকাশ করলে আমরা নিজের আগে অন্যদের সুবিধার কথা চিন্তা করব। আমাদের বাঁ হাতে ব্যথা হলে ডান হাত যেমন তাকে আদর করতে যায়, আমরা যেন সেরকম অন্যদের নিজের মত মনে করে তাদের সেবা করতে পারি।

পৃথিবীতে দুরকমের দারিদ্র আছে। প্রথমটি হল অন্ন-বস্ত্র-গৃহের অভাবের দারিদ্র। আর দ্বিতীয়টি হল প্রেম ও করুণার অভাবের দারিদ্র। এর মধ্যে দ্বিতীয় রকমের দারিদ্রকে প্রথমে দূর করতে হবে। কারণ, আমাদের মধ্যে যদি প্রেম ও করুণা থাকে তবে আমরা প্রাণ দিয়ে তাদের সেবা করতে পারব যারা অন্ন-বস্ত্র-গৃহের অভাবে ভুগছে।

এক গ্রামে এক মহাত্মার দুই হাত বাড়ানো একটি সুন্দর মূর্তি ছিল। মূর্তির নীচে একটি প্লেটে লেখা ছিল, আমার বাহুতে এস। অনেক বছর পরে হাত দুটি ভেঙে গেল। গ্রামবাসীরা মূর্তিটাকে খুব ভালবাসত এবং ভাঙা হাত দেখে তার খুব মুষড়ে পড়ল। তারা সবাই একত্রিত হয়ে আলোচনা করতে লাগল – এখন কী করা যায়। কেউ কেউ বলল যে মূর্তিটাকে নামিয়ে আনা হোক। অন্যরা আপত্তি জানিয়ে বলল যে হাত দুটি নতুন করে বানানো হোক। শেষ পর্য ন্ত এক বৃদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, না, না, নতুন হাত বানানোর ঝামেলা করতে হবে না। হাত ছাড়াই মূর্তিটা থাক। অন্য গ্রামবাসীরা বলল, তা হলে নীচের প্লেটের কী হবে? সেখানে লেখা আছে, আমার বাহুতে এস, বৃদ্ধ উত্তর দিল, কোন সমস্যা নেই। আমার বাহুতে এস লেখার নীচে যোগ করে দাও, তোমাদের হাতের মাধ্যমে আমাকে কাজ করতে দাও।

ভগবানের হাত, চোখ এবং কান আমাদের হতে হবে। আমাদের অনুপ্রেরণা, শক্তি এবং সাহস ভগবানের নিকট থেকে আসতে হবে। তা হলে ভয়, সন্দেহ এবং পাপ কখনও আমাদের স্পর্শ করতে পারবে না।
মোমবাতির আলোয় সূর্য্যের কোন প্রয়োজন নেই। সেইরকম, ভগবান আমাদের নিকট থেকে কিছু চান না। আজ হোক বা কাল হোক, এই দেহ নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং কিছু না করে মরচে পড়ার তুলনায় কর্ম করে ক্ষয় হয়ে যাওয়া কি ভাল নয়? তা নাহলে আমাদের সঙ্গে পোকামাকড়ের পার্থক্য কোথায়? পোকামাকড়রাও খায়-দায়, ঘুমায়, বংশবৃদ্ধি করে এবং শেষ পর্যন্ত মরে যায়। আমাদের জীবনে আমরা এসব ছাড়া আর কী করি?

বাছারা, ভগবান আছেন কি নেই, তা তর্কের বিষয় হতে পারে। যা কিছু হোক না কেন, কোন বুদ্ধিমান লোক কখনও বলতে পারবে না যে ভুক্তভোগী মানুষ নেই; মানুষের দুর্ভোগ আমরা নিজের চোখে দেখতে পাই। এদের সেবা করাকেই আম্মা ভগবানের পূজা মনে করে। আম্মা প্রার্থনা করে তার সন্তানদের মধ্যে যেন এই আত্মত্যাগের মনোভাব বিকশিত হয়। তোমাদের সকলের মধ্য দিয়ে জগত্ দেখুক যে প্রেম, করুণা, নিঃস্বার্থতা এবং আত্মত্যাগের বারি মানুষের হৃদয় থেকে এখনও নিঃশেষ হয়ে যায়নি।

যে গ্রাম আম্মার জন্ম হয়েছিল, সেখানে প্রায় ১০০০ পরিবারের জন্য মাত্র একটি জলের কল ছিল। প্রত্যেকে বড়জোর একটি মাত্র পাত্র ভরতে পারত, কিন্তু তার জন্যেও সকাল থেকে রাত্রি পর্য ন্ত অপেক্ষা করতে হত। কখনও কখনও আমাদের কপালে সে জলও জুটত না। এইসব অভিজ্ঞতার কারণে আম্মা যখন দেখে কোন কল থেকে জল পড়ে যাচ্ছে, তার মনে হয় জল নয়, যেন তার নিজের রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমরা ভাবতে পারি, জলের অপচয় আমরা কেমন করে বন্ধ করতে পারি? এর সমাধান আমরা কোথায় পাব? আম্মা সাধারণ সুযোগ-সবিধা ছাড়াও জীবন যাপন করেছে এবং আশেপাশের মানুষকে ভুগতে দেখেছে। তার ফলে, কাউকে কষ্ট পেতে দেখলে তার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় কী করে তাকে সাহায্য করা যায়। প্রকৃতি আমাদের মাতা। আমাদের জন্মদাত্রী মা আমাদের কয়েক বছর পর্য ন্ত কোলে রাখতে পারেন, কিন্তু প্রকৃতি মাতা আমাদের জীবনের শেষ দিন পর্যদন্ত তাঁর কোলে ধরে রাখেন।

আম্মার একটি ইচ্ছে আছে। সব ইউনিভার্সিটি যেন তাদের ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যাবস্থায় দরিদ্র গ্রামে অথবা শহরের বস্তীতে দু-এক মাসের জন্য পাঠায়। তা হলে তারা দরিদ্রদের সমস্যা নিজের চোখে দেখার সুযোগ পাবে। তারপর সেসব সমস্যার সমাধানের প্রস্তাব রাখতে পারে এবং যা কিছু তারা দেখেছে তা নিয়ে পেপার লিখতে পারে। এতে করে দরিদ্রদের উপযুক্ত সহায়তা দেবার কাজে সাহায্য হবে এবং আজকের যুব-সম্প্রদায়ের মনে করুণার উদ্রেক হবে।

আজ ইউনিভার্সিটি এবং গবেষকদের মূল্যায়ন হয় প্রধানত তারা কত টাকার ফাণ্ডিং পায়, কত পেপার তারা পাব্লিশ করেছে এবং তাদের বুদ্ধির স্তর কেমন তার উপর নির্ভর করে। ঠিক একই মানদণ্ডে অধ্যাপকদের পদোন্নতি হয়। সেই সঙ্গে আমাদের এও হিসাবে ধরা উচিত, তাদের গবেষণার ফলে আমরা দরিদ্র এবং সমাজের অনুন্নত স্তরের মানুষদের কতটা সাহায্য করতে পেরেছি। এরকম হলে মনে হবে যেন সোনা থেকে সুগন্ধ বেরোচ্ছে। বজায়-সম্ভাব্য বিকাশের অনুসন্ধানের পথে আমাদের ভুললে চলবে না যে পিরামিড-এর গোড়ায় যারা আছে তাদের অবস্থা মজবুত হলে পুরো সমাজ স্বাস্থ্যবান এবং মজবুত হবে।

বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতাকে আলাদা করে দেখা গত শতাব্দীতে মানবতার প্রতি সবচেয়ে বড় অপরাধ। জ্ঞানের এই দুটি প্রধান শাখা যেখানে একসাথে এগোবার কথা, সেখানে তাদের ভিন্ন ভিন্ন তকমা মারা হয়েছে হয় আধুনিক বৈজ্ঞানিক বা ধর্মীয় সংস্থার প্রতিনিধি হিসাবে। শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার যুক্তি এবং বুদ্ধির উপর স্থাপিত। সেগুলিই একমাত্র সত্য। ধার্মিক বিশ্বাস অন্ধ এবং ভিত্তিহীন। এই মতবাদ জনগণের মধ্যে প্রচারিত হয়েছে। সাম্প্রতিক কালের সমস্ত প্রাকৃতিক বিপর্য য় এবং ভীতিপ্রদ বিশ্ব-উষ্ণায়ন আমাদের বাসস্থান সুন্দর পৃথিবীর অস্তিত্ব সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলেছে। এখন অনেক মানুষের মনে এই প্রশ্ন উঠছে যে এসবের পিছনে কারণ হল বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতাকে তুলাদণ্ডের বিপরীত দিকে বসিয়ে এককে অপরের তুলনায় বড় করে দেখানোর প্রচেষ্টা।

আমরা যদি আমাদের প্রচেষ্টার সবচেয়ে ভাল ফল চাই, তবে তার জন্য তিনটি জিনিস প্রয়োজন: উপযুক্ত সময়, স্বীয় প্রচেষ্টা এবং ঈশ্বর-কৃপা। উদাহরণ হিসাবে, একজনকে ইন্টারভিউ দেবার জন্য অনেক দূরে যেতে হবে। ভোরবেলা উঠে গাড়ীতে বসে সময় মত এয়ারপোর্টে পেঁছে গেল। কিন্তু চেক-ইন করার পর সে ঘোষণা শুনতে পেল যে হয় তার প্লেনের ইঞ্জিনের কোন গোলযোগ আছে বা আবহাওয়া খারাপ বলে উড়ান যাবে না; তাই তার ফ্লাইট ক্যান্সেল করা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে, লোকটি যথেষ্ট চেষ্টা করেছে এবং ঠিক সময়ে এয়ারপোর্টে পেঁছে গেছে, কিন্তু ঈশ্বরের কৃপার অভাবে সে ইন্টারভিউতে যেতে পারল না। সেইরকম, আমাদের সমস্ত কর্ম সফল এবং অর্থপূর্ণ হতে গেলে তার জন্য চাই ঈশ্বরের কৃপা। আধ্যাত্মিক সাধনা এবং করুণা দুটি আলাদা জিনিস নয়, একই। আমাদের নিঃস্বার্থ কর্ম করুণারূপে আমাদের নিকট ফিরে আসে।

আমাদের জীবন-বৃক্ষ যেন প্রেমের মাটিতে প্রোথিত হয়। সত্কর্ম যেন হয় তার পাতা, মিষ্টি কথা তার ফুল,এবং শান্তি যেন হয় তার ফল। সমস্ত পৃথিবী যেন প্রেমপূর্ণ এক পরিবার হিসাবে গড়ে ওঠে। এমনি করে আমরা যেন শান্তি ও সন্তোষপূর্ণ এক পৃথিবী সৃষ্টি করতে পারি। এটাই আম্মার প্রার্থনা।
ওঁ লোকাঃ সমস্তাঃ সুখিনো ভবন্তু॥