সুদীর্ঘ ১৪ বছর পর আম্মা গুরু-পূর্ণিমার দিনে অমৃতপুরীতে উপস্থিত ছিলেন। সাধারণত এই সময় তিনি জাপান-আমেরিকা যাত্রায় থাকেন। দুমাসের দীর্ঘ বিদেশ যাত্রার অন্তে ২১ তারিখে আশ্রমে ফিরে আসার পরও আম্মা সেদিন সান্ধ্য ভজনে এসেছিলেন এবং গুরু-পূর্ণিমা উত্সবের দিন সকাল ১০:৩০টায় অডিয়োরিয়ামের মঞ্চে উপস্থিত হলেন। পূঃ স্বামী অমৃতস্বরূপানন্দজী আম্মার পাদপূজা করেন। আম্মার অষ্টোত্তরশতনাম ছাড়াও গুরুগীতা এবং বিভিন্ন বৈদিক মন্ত্র আবৃত্তি করা হয়। এরপর আশ্রমের সন্ন্যাসীবৃন্দ আম্মাকে মাল্যার্পণ করেন। প্রায় ১০,০০০ হাজারের মত উপস্থিত ভক্তগণ বিশাল বিশাল প্রজেক্টার স্ক্রিণে এগুলি দেখতে পান। মঞ্চের ঠিক উপরে এক বিশাল এলইডি স্ক্রিণেও এসব দেখানো হয়।

আম্মা তাঁর আশীর্বাণীতে বলেন:
লোকে জিজ্ঞেস করতে পারে, বলেন যে ঈশ্বর আমাদের মধ্যেই বিরাজমান এবং আমাদের সত্য প্রকৃতি থেকে আলাদা নন। তা হলে, সদ্গুরুর শরণাগত হওয়ার দরকার কি? এটা সত্যি যে ঈশ্বর আমাদের মধ্যেই রয়েছেন। সত্যি বলতে কি আমরা সচ্চিদানন্দের প্রতিমূর্তি। কিন্তু সে সত্যের অভিজ্ঞতা কি আমাদের হয়েছে? না, সে সত্য আমাদের অহংকারে আবৃত হয়ে রয়েছে। অন্তরের অমূল্য রত্নভাণ্ডারের চাবি আমাদের কাছে রয়েছে, কিন্তু বহুকাল ব্যবহার না করায় তাতে মরচে ধরে গেছে। আমাদের সাধারণ চাবি থেকে মরচে দূর করার জন্য আমরা যেমন তেল ব্যবহার করি, তেমনি আমাদের অহংকার এবং বাসনা স্বরূপ মরচে দূর করতে হবে। এতে আমাদের সত্য প্রকৃতি প্রকাশে সাহায্য হবে। এই উদ্দেশ্যে আমরা সদ্গুরুর শরণ নিই।

দেহ আর কিছুই নয়, চামড়া দিয়ে আবদ্ধ হাড়মাসের খাঁচা। এর নয়টি দুয়ার আছে। আর আমরা ভাবি, মানে শুধু এই দেহটাই। তাছাড়া, আমরা সারাক্ষণ এই ভুল ধারণাতে ধুনো দিতে থাকি। অহংকার চায় আমরা যেন নিজেকে অন্যদের অপেক্ষা বড় মনে করি এবং চায় অন্যরা যেন আমাদের সম্মান প্রদর্শন করে। আমাদের অহংকার ছাড়া আর সবকিছু ঈশ্বরের সৃষ্টি। একমাত্র অহংকার আমাদের নিজস্ব সৃষ্টি। এই সৃষ্টির বাইরে যাওয়ার চেষ্টা আমাদের করতে হবে। সমুদ্রের বুদ্বুদ বা ঢেউ সমুদ্র থেকে আলাদা কিছু নয়। কিন্তু বুদ্বুদ যদি ভাবে, সে সমুদ্র নয় শুধুমাত্র বুদ্বুদ, তবে কি হবে? সেইরকম, আমাদেরও মনে রাখতে হবে: এই দেহ-মন-অহংকার সম্পন্ন বুদ্বুদ নই। আমি স্বয়ং সমুদ্র। একমাত্র নিরন্তর সাধনা করে এই কথা স্মরণ রাখা সম্ভব।
যখন সদ্গুরুর কাছে মাথা নত করি, আমরা অহংকারের হাত থেকে মুক্তিলাভ করি। আমাদের সত্য প্রকৃতি উদভাসিত হয়ে ওঠে। এই অভিজ্ঞতা হয় যে ঈশ্বর এবং আমরা ভিন্ন নই। ঈশ্বরই আমাদের সত্য প্রকৃতি। বাকী সবকিছু নিজ প্রচেষ্টা দ্বারা লাভ করা সম্ভব, কিন্তু অহংকার থেকে মুক্তিলাভ করার একমাত্র উপায় বিনয় এবং আত্মসমর্পণ। বীজ এবং বৃক্ষ পরস্পর থেকে ভিন্ন নয়। বীজের মধ্যে সম্পূর্ণ বৃক্ষ অন্তর্নিহিত। কিন্তু বীজ মাটির নীচে গিয়ে অংকুরিত না হলে সে কখনও বৃক্ষে পরিণত হবে না। সেইরকম, শিষ্যের মধ্যে যখন আত্মসমর্পণের মনোভাব জাগে, তখন স্বাভাবিক ভাবে অহংকার থেকে মুক্তিলাভ হয়।

শিষ্যকে যতই জাগাবার চেষ্টা করুন না কেন, শিষ্য অন্তর থেকে জেগে ওঠার জন্যে তৈরী না হলে এটা কখনও হবার নয়। যে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে আছে তাকে জাগানো সম্ভব, কিন্তু যে ঘুমের ভান করে পড়ে আছে তাকে জাগানো অসম্ভব। ডিমের খোলা জোর করে ভাঙলে প্রাণ নষ্ট হয়, কিন্তু ডিমের খোলা যখন নিজে থেকে ভাঙে তখন নতুন প্রাণের সৃষ্টি হয়। একই ভাবে, শিষ্য যখন নিজে থেকে অন্তরে জেগে ওঠে, সেটা পুনর্জন্মের মত। সে তখন নিজের সত্য প্রকৃতিতে জেগে ওঠে। সদ্গুরুর সান্নিধ্যে থাকা হল মা-মুরগীর সঙ্গে থাকার মত যে মুরগীশিশুকে নিজের শরীরের উত্তাপ দিয়ে উষ্ণ করে রাখে। গুরুর সান্নিধ্য শিষ্যের মধ্যে অন্তর্নিহিত ঈশ্বরসত্তার বীজ অংকুরিত হওয়ার উপযুক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। গুরু আমাদের সুযোগের পর সুযোগ দেন। সে সুযোগের সদ্ব্যবহার শিষ্যের উপর নির্ভর করে।

আশীর্বাণীর পর আম্মা সবাইকে উঠে দাঁড়াতে অনুরোধ করেন এবং হরি নারায়ণ জয় নারায়ণ গানের তালে তালে নাচতে বলেন। আম্মার সে অপূর্ব ভজনে উপস্থিত ভক্তবৃন্দ মহানন্দে গানের তালে তালে নাচতে শুরু করেন। গনের শেষে বোল্, হরি বোল্ ধ্বনিতে সমস্ত আশ্রম মুখরিত হয়ে ওঠে। এরপর আম্মা সবাইকে দিয়ে বিশ্বশান্তির জন্য প্রার্থনা করান। তিনি মানসচক্ষে দেখতে বলেন যেন সমস্ত বিশ্বে শান্তির পুষ্প ঝরে পড়ছে এবং চতুর্দিক আলোকিত হচ্ছে। এরপর ওঁ লোকাঃ সমস্তাঃ সুখিনো ভবন্তু মন্ত্রের ধ্বনি গুঞ্জিত হয়ে ওঠে।
এরপর আম্মা আগত ভক্তদের দর্শন দিতে আরম্ভ করেন। পরদিন ভোরবেলা ৪:৪৫ ঘটিকায় দর্শন শেষ হয়।