১৪ই সেপ্টেম্বর ২০১৬ – ওনাম উত্সব, অমৃতপুরী
আম্মার আশীর্বাণী
তোমাদের সবাই আম্মার সঙ্গে তিরুওনাম উত্সব পালন করার জন্য একত্রিত হতে দেখে আম্মা খুব খুশি। এতে বোঝা যায আম্মার প্রতি তোমাদের কত টান। তোমাদের পরস্পরের মধ্যেও এরকম প্রেম ও আকর্ষণ সর্বদা থাকা উচিত। কথায় বলে যে ভক্তের আত্মীয়ও ভক্ত। তিরুওনাম এই ঐক্য ও প্রেমের বাণী বহন করে আনে।

ওনাম শাসক এবং শাসিতের মধ্যে আদর্শ সম্পর্কের উদাহরণ স্থাপন করে। মহাবলী নিজের প্রজাদের মঙ্গল ছাড়া আর কিছুই চাইতেন না। প্রজারাও তাদের রাজাকে ভালবাসত। ওনাম উত্সব তাদের সম্পর্কের অটুট বন্ধন – তাদের ঐক্যবোধ, প্রেম এবং সমভাব আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে। শাসকের কেমন হওয়া উচিত? শাসিতের কেমন হওয়া উচিত? ওনাম এর এক আদর্শ তুলে ধরে যা আজকের যুগের বিশেষ প্রয়োজন।

ওনাম মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের উত্সব। এই উত্সবের পরিবেশে পরিবারের সদস্যদের, বন্ধু এবং আত্মীয-স্বজনের পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয। আমরা এমন যুগে বাস করি যেখানে মানুষের পারস্পরিক বন্ধন দুর্বল হযে গেছে। স্বামী-স্ত্রী পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মাতা-সন্তান, পিতা-সন্তান, শিক্ষক-ছাত্র এবং প্রতিবেশীদের মধ্যেও সম্পর্ক দুর্বল হযে যাচ্ছে। ওনাম আমাদের কাছে এইসব সম্পর্ক সজীব এবং সুদৃঢ় করার বাণী নিয়ে আসে। ওনাম তখনই ওনাম হয, যখন এই উদ্দেশ্য সাধিত হয়।

কিন্তু ওনাম শুধুমাত্র মানবিক সম্পর্কের উত্সব নয়। এই উত্সব প্রকৃতি এবং মানবজাতির সম্পর্কেরও উত্সব। তাছাড়া, এটা ভগবানের সঙ্গে মানবজাতির সম্পর্কেরও উত্সব। অন্যান্য উত্সবের তুলনায ওনাম অনেক আলাদা – তার পূর্ণতার কারণে। বাচ্চারা, মেয়েরা, যুব-সম্প্রদায এবং বযোজ্যেষ্ঠ – সকলের এই উত্সবে নিজের নিজের ভূমিকা আছে। পারিবারিক এবং সামাজিক – উভয় স্তরেই এই উত্সব প্রাসঙ্গিক। তাছাড়া এর প্রভাব আমাদের আশেপাশে, সমগ্র প্রকৃতি, আমাদের দেহ এবং মনের উপরেও পড়ে। ওনাম সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং নানারকম শিল্পকলার উত্সবও বটে।

এছাড়া, ওনাম সম্রাট মহাবলীর আমূল পরিবর্তনের কাহিনী বর্ণনা করে। ধার্মিক রাজা হওযা সত্ত্বেও বিভিন্ন সদ্গুণের জন্য তাঁর বিশেষ গর্ব ছিল। গুরু শুক্রাচার্য যখন তাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে সামনে দাঁড়ানো বামন আসলে বিষ্ণু স্বযং, তখন তার মনের মধ্যে সংঘর্ষ আরম্ভ হযে গেল। হয় সত্য স্বীকার করে নিয়ে নিজের নাম ও পদ সবকিছু হারাও অথবা সত্যকে অস্বীকার কর। মহাবলী প্রথম পথটাই বেছে নিয়েছিলেন। সেটা ত্যাগের পথ। অবশেষে বামনের আকার বৃদ্ধি পেল এবং দুই পায়ে তিনি মর্ত্য এবং স্বর্গ অধিকীর করে নিলেন এবং মহাবলীর গর্ব চূর্ণ হয়ে গেল। নিজের কথা রাখার জন্য এবং সত্যকে উপরে স্থান দেবার জন্য তিনি নিজেকেই অর্পণ করলেন। কিন্তু সেই পরাজয় বিজয়ে পরিণত হল। প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম, যে সবকিছু ত্যাগ করেছে, সে সবকিছু লাভ করে। মহাবলী যেন আগুনে পোড়ানো সোনার মত শুদ্ধ হযে গেলেন। তিনি পূর্ণত্ব প্রাপ্ত করলেন এবং অমর খ্যাতি লাভ করলেন।

মহাবলীর হৃদয়ে যে সংঘর্ষ জেগেছিল, সেটা প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে সত এবং অসতের যুদ্ধ, ইতিবাচক এবং নেতিবাচক আবেগ, স্বার্থপরতা এবং নিঃস্বার্থতার মধ্যে যুদ্ধ হিসাবে ঘটে। যারা ধর্মের পথ বেছে নেয়, তারা ভাগ্যবান।

আধুনিক মানব যে নিজের সামর্থ্য নিযে গর্ব করে অথচ জীবনের প্রতিস্পর্দ্ধার সামনে বিচলিত হয, তার কাছে মহাবলীর কাহিনীর শিক্ষা অতি প্রাসঙ্গিক।

মহাবলীর জন্ম অসুর কুলে। প্রহ্লাদের জন্মও অসুর কুলে। বিভীষণ রাক্ষস ছিলেন। তা সত্ত্বেও এই তিনজন আদর্শ পুরুষ হতে পেরেছিলেন। এর থেকে এই কথা প্রমাণিত হয় যে সত্ ভাব সকলের অন্তরে আছে এবং চেষ্টা করলে সেই ভাব আমরা জাগাতে পারি।

আজ আমরা লোকের সম্পদ বা খ্যাতি বা সামাজিক পদমর্যাদার উপরে নির্ভর করে, তারা বড় কি ছোট তা নির্দ্ধারিত করি। এগুলি হারিয়ে গেলে তাদের বড়ত্বও হারিয়ে গেল। এই হল সংসারের নিযম। কিন্তু আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে একথা সত্যি নয়। আমি এবং আমার মনোভাব এবং তাদের সংশ্লিষ্ট আসক্তি ত্যাগ করলে তবেই আধ্যাত্মিক জগতে কাউকে বড় মনে করা হয়। একমাত্র তবেই মানুষ ঈশ্বরে পরিণত হয়। মহাবলী যখন সর্বব্যাপী বিষ্ণু-চৈতন্যে সবকিছু সমর্পণ করলেন, তখন আমি এবং আমার পরিধি অতিক্রম করে পরমাত্মায় গতি লাভ করলেন। এই কাহিনীর এটাই অন্তর্নিহিত আদর্শ।

মহাবলীর রাজত্বকাল এক স্বর্ণযুগ ছিল যখন লোকেরা মিথ্যা কথা বলত না, কেউ কাউকে ঠকাতো না এবং কুত্সা রটাতো না। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। যে যুগে আমরা বাস করছি, সে যুগের একমাত্র আদর্শ মনে হয়, শুধু আমার নিজের সুখ! শুধু আমার নিজের লাভ! এই মনোভাব আমাদের শুধু অন্ধকার এবং দুঃখে ঠেলে দেবে। অনেকে বিশ্বাস করে যে তিরুওনামের দিনে রাজা মহাবলী তার প্রজাদের কাছে এসে তাদের খোঁজখবর নেন। এই বিশ্বাসের পশ্চাতে যে আদর্শ কাজ করছে তা হল, আমাদের স্বার্থপরতার ঝিমুনী থেকে উঠে বিশ্বকে মহাবলীর দৃষ্টি নিয়ে দেখা। সাথী মানুষের প্রতি আমরা যে ছোটখাটো প্রেম বা সম্মান প্রদর্শন করি, তা আমাদের জীবনকে আনন্দপূর্ণ করে। যখন আমাদের মধ্যে প্রত্যেকে মনে করবে যে আমরা অন্যদের সুখী করতে পারি, তখন স্বাভাবিক ভাবে আমাদের হৃদয় আনন্দপূর্ণ হবে। মহাবলী আসলে এই জিনিসটিই চেয়েছিলেন। তার একমাত্র কামনা ছিল তার প্রজারা যেন শান্তি, সমৃদ্ধি, সুখ এবং সন্তোষ লাভ করে। তিনি কখনও নিজের জন্যে কিছু চাননি। প্রজাদের প্রতি মহাবলীর দৃষ্টি বিশ্বের প্রতি মহাত্মার দৃষ্টির মত। এই দৃষ্টিতে স্বার্থপরতার কোন চিহ্ন ছিল না।

জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষালাভ করার আছে। জীবন আমাদের যে শিক্ষা দেবার চেষ্টা করছে, তা বুঝতে হলে আমাদের শ্রদ্ধা ও বিবেকের প্রযোজন। সদসত্ বিচার হল সেই সুইচ যা দিযে জ্ঞানের আলো জ্বালানো যায। সদসত্ বিচারসম্পন্ন লোক প্রতিটি অভিজ্ঞতা, ভাল বা মন্দ যাই হোক, থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে এবং জীবনে যা কিছু আসে, তা হাসিমুখে স্বীকার করে নেয।

ওনামে আমাদের নতুন জামাকাপড় পরার রীতি আছে। সেই সঙ্গে সমাজের কল্যাণের জন্য আমাদের নতুন সিদ্ধান্ত নেবার প্রথাও শুরু করা হোক। বাছারা, তোমরা ওনামের প্রচলিত গান এবং খেলা পছন্দ কর। এই আনন্দকে স্থায়ী করার জন্য আধ্যাত্মিক আদর্শে জীবন যাপন কর। ওনামের জন্য আমরা সবচেযে সুন্দর এবং সবচেযে বড় পুকলম্ (ফুল দিয়ে সাজানো আলপনা) বানাবার জন্য প্রতিযোগিতা করি। একই সঙ্গে এস, আমরা প্রেম, ধৈর্য, আত্মত্যাগ ও বিনয়ে ফুল দিয়ে নিজ হৃদযে পুকলম বানাই। এস, আমরা নিজেদের করুণার পরিধি ও বিস্তার আরও বৃদ্ধি করি। তা যদি আমরা করতে পারি, তবে পুরো জীবন এক বিশাল ওনামে পরিণত হবে।