নববর্ষের আশীর্বাণী

১লা জানুয়ারি ২০১২ অমৃতপুরী

‘‘আমাদের জীবন এবং সমস্ত প্রাণীদের জীবন মঙ্গলময় হোক| এই উপলক্ষ্যে আম্মা এই প্রার্থনা করছে| পরমাত্মা আমাদের মধ্যে এবং বিশ্ব সংসারে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসার জন্যে – আম্মার সন্তানদের মধ্যে জাগরূকতা নিয়ে আসুন| আম্মার প্রার্থনা এই যে এই নববর্ষ যেন নতুন ব্যক্তিমানুষ এবং নতুন সমাজের জন্ম দেয়|

‘‘নববর্ষ একটি শুভ মুহূর্ত যখন লোকেরা বিগত বর্ষের ভুলত্রুটি শোধরাবার চেষ্টা করে এবং কুঁড়েমী দূর করার চেষ্টা করে| নতুন করে শুরু করার আগ্রহ এবং উত্সাহ জাগে| অনেকে নববর্ষে নির্ণায়ক সিদ্ধান্ত নেয়| তারা নতুন অভ্যাস তৈরী করতে শুরু করে| অনেকে ডায়ারী লিখতে শুরু করে| কিন্তু ছ’মাস পরে আমরা যদি সেই ডায়ারী খুলে দেখি তবে দেখা যাবে যে মাত্র প্রথম দু সপ্তাহ – খুব বেশী হলে তিন মাস লেখা হয়েছে| অনেকের জীবনে আমরা এরকম দেখতে পাই| শুভ কাজ শুরু করার পর তাতে লেগে থাকা আমাদের দ্বারা হয় না| অবিরাম প্রচেষ্টা সর্বদা প্রশংসা লাভ করে| উদাহরণ হিসাবে, কেউ সেনাবাহিনী বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে অনেক দিন কাজ করলে সেই প্রতিষ্ঠান তাকে সম্মানিত করে| কিন্তু আমাদের সত্কর্ম ও সংকল্প আমরা বজায় রাখি না| অনেকে যৌগিক আসন করতে শুরু করে, কিন্তু দু-তিন দিনের মধ্যেই ছেড়ে দেয়| অনেক সন্তানেরা বহু উত্সাহে ধ্যান করতে শুরু করে, কিন্তু মাসদুয়েক পরে বন্ধ করে দেয়| সত্ কর্ম করাতে আমাদের দেরী করা উচিত নয়| আমাদের মন সদা পরিবর্তনশীল| ভাল কথা বলার জন্য, সত্ কর্ম করার জন্য এবং ধৈর‌্য ও করুণা অভ্যাস করার জন্য আমাদের নিরন্তর জাগরূকতা এবং সচেতন প্রচেষ্টা চাই| এইসব কর্ম ধীরে ধীরে অভ্যাসে দাঁড়াবে এবং পরে স্বতস্ফূর্ত হয়ে যাবে| এরকম অভ্যাস জীবনে সাফল্য নিয়ে আসে|

‘‘জীবন-খাতার প্রতি পাতায় তারা কী লিখবে, সে সম্বন্ধে মানুষকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে| ভগবান আমাদের কাগজ কলম দিয়েছেন, কিন্তু তিনি আমাদের কখনও বলবেন না কী লিখতে হবে| তিনি শুধু ইঙ্গিত দিতে থাকবেন| সেখানে আমরা কী লিখব, সেটা তিনি পুরোপুরি আমাদের উপর ছেড়ে দিয়েছেন| সে স্বাধীনতা আমাদের আছে| আমরা যদি ইচ্ছা করি, তবে সেখানে সদিচ্ছার চিঠি লিখতে পারি – প্রেম ও সৌন্দর‌্য সম্বন্ধে লিখতে পারি| আর যদি ইচ্ছা করি, তবে আমরা ঘৃণা ও কুত্সিত্ ভাব প্রকাশ করে খারাপ চিঠিও লিখতে পারি| সত্কর্ম এবং অসত্কর্ম উভয়ের ফলাফল সম্বন্ধে আমাদের ইঙ্গিত দিতে থাকবেন| ২০১১ সালে মানবজাতি এরকম কত ইঙ্গিত তাঁর কাছ থেকে পেয়েছে|

‘‘প্রাকৃতিক বিপর‌্যয়, সামাজিক সংঘাত এবং অর্থব্যবস্থা বিপন্ন হওয়া এসব জিনিস সারা পৃথিবীতে কত লোকের ঘুম নষ্ট করেছে| মানুষের মনে ভয় ও উদ্বেগ দিনের পর দিন তীব্রতর হচ্ছে| মানুষের সদসত্ বিচারহীন কর্ম প্রকৃতির সামঞ্জস্য নষ্ট করেছে| বায়ু, জল এবং মাটি বিষাক্ত হয়ে গেছে| প্রকৃতি আগে কামধেনুর মত ছিল, এখন শুকিয়ে গেছে| খনিজ তেলের পরিমাণ দ্রুতগতিতে কমে চলেছে| খাদ্য পদার্থের উত্পাদন কমে আসছে| পান করার মত যোগ্য জল এবং শুদ্ধ বাতাস আজ দুর্লভ| আমাদের কী ভুল হয়েছে? আমাদের সত্যিকারের ভুল হল আমরা প্রয়োজন এবং বিলাসিতার মধ্যে পার্থক্য করতে পরিনি|

‘‘আমাদের বর্তমান প্রজন্ম যদি এই ধর্ম (কর্তব্য) সম্বন্ধে জাগরূক হয় তা হলে দারিদ্র এবং অনাহার দুঃস্বপ্নের মত মিলিয়ে যাবে|

‘‘সময় যে বয়ে যায়, নববর্ষ আমাদের সে কথা মনে করায়| ফাটা কলস থেকে যেমন ফোঁটা ফোঁটা জল বেরিয়ে যায়, তেমনি আমাদের আয়ু প্রতি মিনিটে কমে যাচ্ছে| মানুষ হিসাবে পৃথিবীতে আমাদের সবচেয়ে অমূল্য ধন হল সময়| একমাত্র সময় ছাড়া বাকী সব হারানো জিনিস আবার উপার্জন করা সম্ভব| এই কথা মনে রেখে আমাদের উচিত প্রতি মুহূর্ত পূর্ণ জাগরূকতা সহকারে জীবন যাপন করা| আমাদের এও মনে রাখা উচিত যে ঘড়ির কাঁটার প্রতি টিক টিক শব্দ আসলে মৃতু্যর পায়ের শব্দ যা প্রতি মুহূর্তে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে|

‘‘যা কিছু আমরা পৃথিবীতে দেখি, শুনি বা উপলব্ধি করি, সেগুলি নশ্বর| যা সবকিছুর শাশ্বত আধার, সেই আত্মাকে আমাদের খুঁজে বার করতে হবে| তা হলে আমরা ৱুঝতে পারব যে পৃথিবীতে আমাদের থেকে আলাদা কেউ নেই|

‘‘আমরা হাসি বা কাঁদি, দিন তো পেরিয়েই যাবে| তা হলে হাসিমুখে কেন জীবন কাটাই না? হাসি আত্মার সঙ্গীত| অন্যদের দোষ দেখে আমাদের হাসা উচিত নয়| প্রত্যেকের মধ্যে আমরা যেন তাদের ভালটা দেখতে পাই এবং কায়মনোবাক্যে যেন সকলের সঙ্গে সদ্ভাবের আদান প্রদান করতে পারি| নিজেদের ভুল বা দুর্বলতা দেখে আমাদের হাসতে চেষ্টা করা উচিত|

‘‘অনেক সন্তানেরা আম্মাকে বলে যে ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে| আম্মা মনে করে না যে এরকম কিছু হবে| পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন স্থানে কিছু ঘটনা ঘটতে পারে| আমরা যদি পৃথিবীর দিকে দেখি, আমরা যদি জলের দিকে তাকাই, আমরা যদি বায়ুর দিকে তাকাই, আমরা যদি প্রকৃতির দিকে তাকাই – সর্বত্র দেখব আলোড়ন চলছে| এই আলোড়ন পৃথিবীর কোথাও না কোথাও বজ্রের মত আঘাত করবে| যাই হোক, মৃতু্য জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ| এটা যে কোন সময় যে কোন জায়গায় হতে পারে| কিন্তু লেখার সময় একটি বাক্যের শেষে আমরা যেমন যতি চিহ্ন দিই এবং আর এক নতুন বাক্য লেখা শুরু করি, তেমনি একটি জীবনের অবসান আর একটি নব জীবনের সূত্রপাত করে| কিন্তু আমাদের ভয়ের জীবন যাপন করা উচিত নয়| তার পরিবর্তে আমাদের সবকিছু স্বীকার করে নেওয়ার মনোভাবের বিকাশ করা উচিত| আমাদের মনোভাব হওয়া উচিত, ‘‘যা কিছু হোকনা কেন, আমি শক্ত, সাহসী এবং সুখী থাকব|’’ ভয়ের কবলে জীবন যাপন করা হল বোমার উপর শুয়ে থাকার মত| আমরা কখনও শান্তিতে ঘুমাতে পারব না| কিন্তু আবার বলছি, আম্মার মনে হয় না সাংঘাতিক কিছু ঘটবে| শোকের ঘটনা পৃথিবীর সর্বত্র ঘটছে| আজও, রাস্তা দিয়ে যাবার সময় আমরা দুর্ঘটনা কি দেখতে পাই না? বিমান ভেঙে পড়েছে এমন খবর কি আমরা শুনতে পাই না? বন্যা, ভূকম্প, ঘুর্ণীঝড় এবং ত্সুনামি অবিরত ঘটে চলেছে| আমরা যেখানেই থাকি না কেন, আমরা যেন সুখে থাকতে পারি এবং নিজের সত্য প্রকৃতির উপর আস্থা রাখতে পারি| আমরা যেন সত্কর্ম করতে পারি|

‘‘কীটপতঙ্গ জন্মগ্রহণ করে, বংশবৃদ্ধি করে এবং মারা যায়| পশুরাও তাই করে| মানুষও যদি একইভাবে বেঁচে থাকে তবে আমাদের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীদের তফাত্ কোথায়? আমরা পৃথিবীর উদ্দেশ্যে কী বলতে পারি? নিজেদের নিঃস্বার্থ সেবার ফলে মহাত্মাগণ চিরকাল বেঁচে থাকেন| তাঁদের মত অতটা না করতে পারলেও, আমাদের একটু চেষ্টা করা উচিত অন্যদের জন্য আমরা কী করতে পারি| মরুভূমিতে একটি মাত্র গাছ যদি হয় তবে ততটুকু ছায়া পাওয়া যাবে| যদি একটি মাত্র ফুল ফোটে, তা হলে অন্তত ততটুকু সৌন্দর‌্য সৃষ্টি হবে| একটা ‘জিরো পাওয়ারের’ বালবের আলোয় আমরা পড়তে পারব না, কিন্তু যখন এরকম অনেকগুলি বালব একসঙ্গে জ্বলে তখন আমরা ঠিকমত দেখতে পারব| সেইরকম, ঐক্যের সাহায্যে আমরা কতকিছু করতে পারি| পৃথিবী হল একটি হ্রদের মত যা একটি মানুষের পক্ষে পরিষ্কার করা সম্ভব নয়| কিন্তু সবাই যদি নিজের নিজের অংশটি পরিষ্কার করে, তা হলে আমরা একত্রে পৃথিবী পরিষ্কার করতে পারি| আমাদের কুঁড়ে হওয়া উচিত নয়| যা আমাদের সাধ্যের মধ্যে ততটুকু যেন আমরা করতে পারি| এমনি করে আমরা নিশ্চিত ভাবে লক্ষ্য পূর্ণ করতে পারব|

‘‘অন্য যে কোন সিদ্ধান্তের মত সুখও একটি সিদ্ধান্ত – দৃঢ় সিদ্ধান্ত যে ‘যা কিছু হোকনা কেন, আমি সুখী থাকব| আমি শক্তিশালী হব| আমি কখনও একলা নই| পরমাত্মা সর্বদা আমার সঙ্গে আছেন|’ আমার সন্তানেরা যেন প্রয়োজনীয় মানসিক শক্তি সম্পন্ন হয় এবং তারা যেন উত্সাহ ও আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ হয়| ঈশ্বরের কৃপা আমার সব সন্তানদের উপর বর্ষিত হোক|’’

অমৃতা ওয়াটোটো বোমা

৫ই এপ্রিল, ২০১১, কেনিয়া

কেনিয়ার উপরাষ্ট্রপতি মাননীয় শ্রী কালোঞ্জো মুসোইয়োকা আম্মার উপস্থিতিতে কেনিয়ার মাতা অমৃতানন্দময়ী চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দ্বারা নির্মিত শিশু নিকেতনের দ্বার উদঘাটন করেন| আথি নদীর তীরে এই সমারোহে অন্য গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন কেনিয়ার ক্রীড়া ও সংস্কৃˆতি উপমন্ত্রী শ্রীমতী ওয়াবিন্যা ন্ডেটি, কয়েকজন সাংসদ, জেলা শাসক এবং বিখ্যাত গায়ক এরিক ওয়াইনাইনা| শিশু নিকেতনে প্রারম্ভিক স্তরে ১০৮টি শিশু স্থান পাবে|

শিশু নিকেতন ছাড়া আরও দুটি প্রকল্প এদিন শুরু করা হয় – অমৃতা অর্থকরী বিদ্যা শিক্ষাকেন্দ্র এবং অমৃতা পানীয় জল সরবরাহ প্রকল্প|

৩৫টি কম্পু্টার সম্বলিত অমৃতা অর্থকরী বিদ্যা শিক্ষাকেন্দ্রের উদ্দেশ্য নিকটবর্তী জ্যাম সিটিস্থিত বস্তিবাসীদের শিক্ষা প্রদান| কেন্দ্রের প্রথম ব্যাচে ৫০ জন প্রাথমিক কম্পুটার ব্যবহার করা শিখেছে|

অমৃতা পানীয় জল সরবরাহ প্রকল্প শিশু নিকেতন সংলগ্ন মাসাই উপজাতিয়দের পানীয় জল সরবরাহ করবে| এই অঞ্চলে অনাবৃষ্টির কারণে খুব জলের অভাব|

(১লা নভেম্বর, ২০১০ কেরলে আম্মার সন্তানেরা প্রথম আবর্জনা পরিষ্কার অভিযান আরম্ভ করে. সেই ভিডিয়ো দেখার পর আম্মা ইউরোপ থেকে সন্তানদের নিম্নে উল্লিখিত চিঠি লিখেছিলেন.)

ওঁ নমঃ শিবায়

সোনারা আমার:

আম্মা যখন দেখল তার সন্তানেরা কেমন করে নিঃস্বার্থ ভাবে পরিষ্কার করার কাজে মেতেছে, আনন্দে আম্মার প্রাণ ভরে গেল. আম্মার মনে হল ছুটে তোমাদের কাছে যায় এবং তোমাদের প্রত্যেককে জড়িয়ে ধরে আদর করে. আম্মা আশা করে যে তোমাদের উদাহরণ সারা দেশে এক নব জাগরণ নিয়ে আসবে.

যারা অন্যদের পথ থেকে কাটা দূর করে তারা নিজের পথে ফুলের পাপড়ি বিছায়. আম্মা সর্বদা বলে, ‘‘আমরা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নই, আমরা শিকলের এক একটি কড়ির মত. যা কিছু আমরা করি তা জ্ঞাতে অজ্ঞাতে অন্যদের উপর প্রভাব বিস্তার করে. সুতরাং, অন্যদের মধ্যে পরিবর্তন আসার জন্য আমাদের অপেক্ষা করা উচিত নয়. আমরা বদলালে, অন্যরা নিজে থেকে বদলাবে.’’

বাছারা, তোমাদের কর্মের দ্বারা তোমরা এক নতুন ধারণার জন্ম দিতে শুরু করেছ. তোমরা এক মহান সংস্কারের বীজ বপন করেছ. আত্মসমর্পণ এবং নিষ্ঠার সঙ্গে যে মহান যজ্ঞ তোমরা শুরু করেছ, তা নিশ্চয়ই অন্যদের মধ্যে অনুপ্রেরণা জাগাবে. যে সত্কর্ম তোমরা আজ করেছ তা নিঃসন্দেহে আগামীকালের অশ্রুপাত কম করতে সাহায্য করবে. সেটা আমাদের দেশের পরিচ্ছন্নতা, সৌন্দর্য এবং পবিত্রতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে. আম্মা পরমাত্মার নিকট প্রার্থনা করছে যেন তিনি তার সন্তানদের শক্তি প্রদান করেন যাতে তারা মাতৃভূমির সেবা করতে পারে এবং দেশের মঙ্গলের জন্যে কর্ম করতে পারে.

প্রতিটি প্রিয় সন্তানকে আম্মার হৃদয় থেকে চুমু ও আদর ….

প্রশ্ন: বর্তমান সমস্যার সমাধান কী করে করা যায়?

আম্মা: বর্তমান সমস্যাগুলি খুবই চিন্তার বিষয়. সমস্যাগুলির কারণ জানা জরুরী এবং তারপর তাদের সমাধান করতে হবে. কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার যে পরিবর্তন একজনকে দিয়েই শুরু হয়. একজন লোক শুধরে গেলে পুরো পরিবার লাভবান হয় এবং সমাজও লাভবান হয়. সুতরাং, প্রথমে আমাদের নিজেকে শোধরাবার চেষ্টা করতে হবে. আমরা ঠিক হলে আমাদের আশেপাশের সকলের উপরেও তার প্রভাব পড়বে. তাদের মধ্যেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে. শুধুমাত্র উপদেশ দিয়ে বা বকাবকি করে আমরা কারও মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারি না. আমাদের নিজেদের উদাহরন স্থাপন করা উচিত. সকলের প্রতি আমাদের স্নেহ ও উদার মনোভাব থাকা উচিত. একমাত্র অটল প্রেম দ্বারাই আমরা অন্যদের মধ্যে পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারি. হতে পারে যে পরিবর্তনের লক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তাই বলে আমাদের প্রচেষ্টা ত্যাগ করা উচিত নয় এবং আশা বজায় রাখা উচিত. আমাদের প্রচেষ্টা অন্তত আমাদের মধ্যে নিশ্চিত ভাবে সুপরিবর্তন নিয়ে আসবে.

যদি আমরা কুকুরের লেজকে পাইপে ঢুকিয়ে চাপ দিয়ে সোজা করার চেষ্টা করি, তবে লেজ সোজা না হলেও আমাদের হাতের মাংসপেশী মজবুত হবে. কিন্তু য্খন আমরা নিজেকে উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করি, তা হলে আমরা তো শোধরাবই, বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও অন্যদের মধ্যেও কিছু পরিবর্তন নিশ্চিত রূপে নিয়ে আসে. অন্তত আমাদের প্রচেষ্টার ফলে সমাজের আরও অধপতন বন্ধ করা সম্ভব. এরকম প্রচেষ্টাজ ফলে আমরা সমাজে কিছু সদ্ভাব ও সামঞ্জ্স্য নিয়ে আসতে পারি.

স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটলে লোকে এগোতে পারে না, কিন্তু স্রোতে বয়ে যাবার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে. চেষ্টা ছেড়ে দিলে ডুবে যাবে. সেরকম, চেষ্টা আমাদের বজায় রাখতে হবে.

তোমরা ভাবতে পার, “এই অন্ধকার সংসারে একা সংঘর্ষ করে কী লাভ হতে পারে?” আমাদের সকলের কাছে একটা মোমবাতি আছে – মনের মোমবাতি. তাতে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের শিখা জ্বালাও. এ কথা আদৌ ভেব না, এইটুকু আলো দিয়ে
পুরো রাস্তা কেমন করে পার হব. এক পা এক পা করে এগিয়ে যাও. দেখতে পাবে পুরো রাস্তায় প্রতি পদের জন্য যথেষ্ট আলো রয়েছে.

একজন রাস্তার ধারে একেবারে হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে. এক পথিক যেতে যেতে তার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকী হাসি দিল. সে হাসিতে লোকটি প্রভাবিত হল. কেউ অন্তত তার জন্য একটু ভাবে, এই বিশ্বাসে তার মধ্যে নতুন শক্তি এসে গেল. অনেকদিন যাবত দেখা হয়নি, এমন এক বন্ধুকে সে একটা চিঠি লিখল. চিঠি পেয়ে বন্ধু এত খুশি হল যে পাশে দাঁড়ানো এক গরীব মহিলাকে দশ টাকার একটা নোট দিল. মহিলা সেই টাকা দিয়ে লটারির টিকিট কিনল. আশ্চর্যের ব্যাপার, মহিলা লটারি জিতে গেল. লটারির টাকা নিয়ে সে য্খন বাড়ী ফিরছিল, তখন দেখে রাস্তায় এক গরীব ভিখারী অসুস্থ হয়ে পড়ে রয়েছে. মহিলা ভাবল, “ভগবান য্খন আমার উপর এত কৃপা করেছেন, তখন আমারও ওকে সাহায্য করা উচিত.” সে ভিখারীকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তার চিকিত্সার বন্দোবস্ত করল. ভিখারী হাসপাতাল থেকে বাড়ী ফেরার পথে রাস্তায় অভুক্ত জীর্ণ শীর্ণ একটি বাচ্চা কুকুর দেখতে পেল, ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে কুঁ কুঁ করে কাঁদছে. ভিখারীর মনে দয়া হল. সে কুকুরের বাচ্চাটাকে কাপড় দিয়ে জড়িয়ে আগুনের কাছে নিয়ে গেন. নিজের খাবারের ভাগ থেকে তাকে খাওয়ান. আদরে যত্নে বাচ্চা কুকুর বেশ তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে গেল এবং ভিখারীর সঙ্গে সঙ্গে সব জায়গায় যাতায়াত করতে লাগল. রাত্রিবেলা ভিখারী এক বাড়ীতে আশ্রয় চাইল. সে বাড়ীর লোক তাকে বাইরের বারান্দায় জায়্গা দিল. রাত্রে কুকুরের বাচ্চার চিত্কারে বাড়ীর লোকের ঘুম ভেঙে গেল. তারা দেখল বাচ্চার ঘরের পাশেই আগুন লেগেছে. তারা কোনরকমে বাচ্চাকে বের করে আনল এবং তাড়াতাড়ি আগুন নিভিয়ে ফেলল. এমনি করে এক সত্কর্ম থেকে আর এক সত্কর্মের উত্পত্তি হল. ভিখারীকে শরণ দিয়েছিল বলে তার কুকুর পরিবারকে আগুনের হাত থেকে বাঁচাল. সেই বাচ্চা বড় হয়ে সাধু হল এবং তার প্রবচন শুনে অগণিত লোক শান্তি ও আনন্দ লাভ করল.

এই কাহিনী বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সমস্ত সত্কর্মের আরম্ভ একজনের মুচকি হাসি থেকে. সে কোন কিছুই করেনি, শুধু এক পথিককে দেখে একটু মুচকি হেসেছিল. একটু মিষ্টি হাসি থেকে কত লোকের জীবন আলোয় ভরে গেল.

অপরের কল্যাণের জন্য করা ছোট ছোট কাজও সমাজে বড় পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে. ফল তত্ক্ষণাত্ না দেখতে পেলেও, প্রতিটি সত্কর্ম সর্বদা সুফল দেয়. সুতরাং, আমাদের সর্বদা লক্ষ রাখা উচিত যে আমাদের প্রতিটি কর্ম অপরের মঙ্গলের জন্য হয়.
একটু মুচকি হাসিও বহুমূল্যবান এবং তার জন্য আমাদের কোন খরচ করতে হয় না. দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, আজকাল লোক বেশীরভাগ সময় অন্যদের উপহাস করার জন্য হাসে. হাসি এরকম হওয়া উচিত নয়. বরং, আমাদের নিজের ভুল এবং দুর্বলতার জন্য হাসতে পারা উচিত.

কোন মানুষ আলাদা আলাদা দ্বীপ নয়. আমরা সবাই শিকলের কড়ির মত একসূত্রে বাঁধা. আমরা জানি অথবা না জানি, আমাদের কার্য অন্যদের উপরে প্রভাব বিস্তার করে. একজনের মধ্যে পরিবর্তন এলে তা অন্যদের মধ্যেও লক্ষ করা যায়.

এ কথা বলার কোন মানে হয় না, “আগে অন্যরা বদলাক, তারপর আমি বদলাবার চেষ্টা করব.” আমরা যদি নিজেকে বদলাবার জন্য প্রস্তুত হই, তবে তার প্রভাব ও পরিবর্তন আমরা সমাজে দেখতে পাব. নিজের মধ্যে সেই বাঞ্ছিত পরিবর্তন যদি তুমি না দেখতে পাও তবে হতাশ হয়ো না, সে পরিবর্তন ভিতরে ভিতরে হচ্ছে. আর আমাদের অন্তরে হওয়া মঙ্গলময় পরিবর্তন নিশ্চিত রূপে সমাজেও মঙ্গলময় পরিবর্তন নিয়ে আসবে.

২৭শে সেপ্টেম্বর, ২০১০, অমৃতপুরী. আম্মার ৫৭-তম জন্মদিবস উপলক্ষ্যে মঠ এই প্রকল্পের প্রসারণের ঘোষণা করেছে. এল.আই.সি.-র সঙ্গে যুক্তভাবে মঠ গোষ্ঠীর সদস্যদের জীবনবীমা ও দুর্ঘটনাবীমার ব্যবস্থা করেছে. শুরুতে অমৃতাশ্রীর ১০,০০০ সদস্যা এই পলিসি লাভ করবেন.

স্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে পলিসি ৪০,০০০ টাকা, দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়ে মৃত্যু হলে ৮৫,০০০ টাকা, সাময়িক প্রতিবন্ধীতার জন্য ৩৫,০০০ এবং স্থায়ী প্রতিবন্ধীতার জন্য ৭৫,০০০ টাকা মূল্যের হবে. তা ছাড়া, এই প্রকল্পের অঙ্গ হিসাবে মঠ ১৫% সদস্যাদের সন্তানদের বার্ষিক ১,২০০ টাকা ছাত্রবৃত্তি দেবে.