নববর্ষের আশীর্বাণী

১লা জানুয়ারি ২০১২ অমৃতপুরী

‘‘আমাদের জীবন এবং সমস্ত প্রাণীদের জীবন মঙ্গলময় হোক| এই উপলক্ষ্যে আম্মা এই প্রার্থনা করছে| পরমাত্মা আমাদের মধ্যে এবং বিশ্ব সংসারে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসার জন্যে – আম্মার সন্তানদের মধ্যে জাগরূকতা নিয়ে আসুন| আম্মার প্রার্থনা এই যে এই নববর্ষ যেন নতুন ব্যক্তিমানুষ এবং নতুন সমাজের জন্ম দেয়|

‘‘নববর্ষ একটি শুভ মুহূর্ত যখন লোকেরা বিগত বর্ষের ভুলত্রুটি শোধরাবার চেষ্টা করে এবং কুঁড়েমী দূর করার চেষ্টা করে| নতুন করে শুরু করার আগ্রহ এবং উত্সাহ জাগে| অনেকে নববর্ষে নির্ণায়ক সিদ্ধান্ত নেয়| তারা নতুন অভ্যাস তৈরী করতে শুরু করে| অনেকে ডায়ারী লিখতে শুরু করে| কিন্তু ছ’মাস পরে আমরা যদি সেই ডায়ারী খুলে দেখি তবে দেখা যাবে যে মাত্র প্রথম দু সপ্তাহ – খুব বেশী হলে তিন মাস লেখা হয়েছে| অনেকের জীবনে আমরা এরকম দেখতে পাই| শুভ কাজ শুরু করার পর তাতে লেগে থাকা আমাদের দ্বারা হয় না| অবিরাম প্রচেষ্টা সর্বদা প্রশংসা লাভ করে| উদাহরণ হিসাবে, কেউ সেনাবাহিনী বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে অনেক দিন কাজ করলে সেই প্রতিষ্ঠান তাকে সম্মানিত করে| কিন্তু আমাদের সত্কর্ম ও সংকল্প আমরা বজায় রাখি না| অনেকে যৌগিক আসন করতে শুরু করে, কিন্তু দু-তিন দিনের মধ্যেই ছেড়ে দেয়| অনেক সন্তানেরা বহু উত্সাহে ধ্যান করতে শুরু করে, কিন্তু মাসদুয়েক পরে বন্ধ করে দেয়| সত্ কর্ম করাতে আমাদের দেরী করা উচিত নয়| আমাদের মন সদা পরিবর্তনশীল| ভাল কথা বলার জন্য, সত্ কর্ম করার জন্য এবং ধৈর‌্য ও করুণা অভ্যাস করার জন্য আমাদের নিরন্তর জাগরূকতা এবং সচেতন প্রচেষ্টা চাই| এইসব কর্ম ধীরে ধীরে অভ্যাসে দাঁড়াবে এবং পরে স্বতস্ফূর্ত হয়ে যাবে| এরকম অভ্যাস জীবনে সাফল্য নিয়ে আসে|

‘‘জীবন-খাতার প্রতি পাতায় তারা কী লিখবে, সে সম্বন্ধে মানুষকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে| ভগবান আমাদের কাগজ কলম দিয়েছেন, কিন্তু তিনি আমাদের কখনও বলবেন না কী লিখতে হবে| তিনি শুধু ইঙ্গিত দিতে থাকবেন| সেখানে আমরা কী লিখব, সেটা তিনি পুরোপুরি আমাদের উপর ছেড়ে দিয়েছেন| সে স্বাধীনতা আমাদের আছে| আমরা যদি ইচ্ছা করি, তবে সেখানে সদিচ্ছার চিঠি লিখতে পারি – প্রেম ও সৌন্দর‌্য সম্বন্ধে লিখতে পারি| আর যদি ইচ্ছা করি, তবে আমরা ঘৃণা ও কুত্সিত্ ভাব প্রকাশ করে খারাপ চিঠিও লিখতে পারি| সত্কর্ম এবং অসত্কর্ম উভয়ের ফলাফল সম্বন্ধে আমাদের ইঙ্গিত দিতে থাকবেন| ২০১১ সালে মানবজাতি এরকম কত ইঙ্গিত তাঁর কাছ থেকে পেয়েছে|

‘‘প্রাকৃতিক বিপর‌্যয়, সামাজিক সংঘাত এবং অর্থব্যবস্থা বিপন্ন হওয়া এসব জিনিস সারা পৃথিবীতে কত লোকের ঘুম নষ্ট করেছে| মানুষের মনে ভয় ও উদ্বেগ দিনের পর দিন তীব্রতর হচ্ছে| মানুষের সদসত্ বিচারহীন কর্ম প্রকৃতির সামঞ্জস্য নষ্ট করেছে| বায়ু, জল এবং মাটি বিষাক্ত হয়ে গেছে| প্রকৃতি আগে কামধেনুর মত ছিল, এখন শুকিয়ে গেছে| খনিজ তেলের পরিমাণ দ্রুতগতিতে কমে চলেছে| খাদ্য পদার্থের উত্পাদন কমে আসছে| পান করার মত যোগ্য জল এবং শুদ্ধ বাতাস আজ দুর্লভ| আমাদের কী ভুল হয়েছে? আমাদের সত্যিকারের ভুল হল আমরা প্রয়োজন এবং বিলাসিতার মধ্যে পার্থক্য করতে পরিনি|

‘‘আমাদের বর্তমান প্রজন্ম যদি এই ধর্ম (কর্তব্য) সম্বন্ধে জাগরূক হয় তা হলে দারিদ্র এবং অনাহার দুঃস্বপ্নের মত মিলিয়ে যাবে|

‘‘সময় যে বয়ে যায়, নববর্ষ আমাদের সে কথা মনে করায়| ফাটা কলস থেকে যেমন ফোঁটা ফোঁটা জল বেরিয়ে যায়, তেমনি আমাদের আয়ু প্রতি মিনিটে কমে যাচ্ছে| মানুষ হিসাবে পৃথিবীতে আমাদের সবচেয়ে অমূল্য ধন হল সময়| একমাত্র সময় ছাড়া বাকী সব হারানো জিনিস আবার উপার্জন করা সম্ভব| এই কথা মনে রেখে আমাদের উচিত প্রতি মুহূর্ত পূর্ণ জাগরূকতা সহকারে জীবন যাপন করা| আমাদের এও মনে রাখা উচিত যে ঘড়ির কাঁটার প্রতি টিক টিক শব্দ আসলে মৃতু্যর পায়ের শব্দ যা প্রতি মুহূর্তে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে|

‘‘যা কিছু আমরা পৃথিবীতে দেখি, শুনি বা উপলব্ধি করি, সেগুলি নশ্বর| যা সবকিছুর শাশ্বত আধার, সেই আত্মাকে আমাদের খুঁজে বার করতে হবে| তা হলে আমরা ৱুঝতে পারব যে পৃথিবীতে আমাদের থেকে আলাদা কেউ নেই|

‘‘আমরা হাসি বা কাঁদি, দিন তো পেরিয়েই যাবে| তা হলে হাসিমুখে কেন জীবন কাটাই না? হাসি আত্মার সঙ্গীত| অন্যদের দোষ দেখে আমাদের হাসা উচিত নয়| প্রত্যেকের মধ্যে আমরা যেন তাদের ভালটা দেখতে পাই এবং কায়মনোবাক্যে যেন সকলের সঙ্গে সদ্ভাবের আদান প্রদান করতে পারি| নিজেদের ভুল বা দুর্বলতা দেখে আমাদের হাসতে চেষ্টা করা উচিত|

‘‘অনেক সন্তানেরা আম্মাকে বলে যে ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে| আম্মা মনে করে না যে এরকম কিছু হবে| পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন স্থানে কিছু ঘটনা ঘটতে পারে| আমরা যদি পৃথিবীর দিকে দেখি, আমরা যদি জলের দিকে তাকাই, আমরা যদি বায়ুর দিকে তাকাই, আমরা যদি প্রকৃতির দিকে তাকাই – সর্বত্র দেখব আলোড়ন চলছে| এই আলোড়ন পৃথিবীর কোথাও না কোথাও বজ্রের মত আঘাত করবে| যাই হোক, মৃতু্য জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ| এটা যে কোন সময় যে কোন জায়গায় হতে পারে| কিন্তু লেখার সময় একটি বাক্যের শেষে আমরা যেমন যতি চিহ্ন দিই এবং আর এক নতুন বাক্য লেখা শুরু করি, তেমনি একটি জীবনের অবসান আর একটি নব জীবনের সূত্রপাত করে| কিন্তু আমাদের ভয়ের জীবন যাপন করা উচিত নয়| তার পরিবর্তে আমাদের সবকিছু স্বীকার করে নেওয়ার মনোভাবের বিকাশ করা উচিত| আমাদের মনোভাব হওয়া উচিত, ‘‘যা কিছু হোকনা কেন, আমি শক্ত, সাহসী এবং সুখী থাকব|’’ ভয়ের কবলে জীবন যাপন করা হল বোমার উপর শুয়ে থাকার মত| আমরা কখনও শান্তিতে ঘুমাতে পারব না| কিন্তু আবার বলছি, আম্মার মনে হয় না সাংঘাতিক কিছু ঘটবে| শোকের ঘটনা পৃথিবীর সর্বত্র ঘটছে| আজও, রাস্তা দিয়ে যাবার সময় আমরা দুর্ঘটনা কি দেখতে পাই না? বিমান ভেঙে পড়েছে এমন খবর কি আমরা শুনতে পাই না? বন্যা, ভূকম্প, ঘুর্ণীঝড় এবং ত্সুনামি অবিরত ঘটে চলেছে| আমরা যেখানেই থাকি না কেন, আমরা যেন সুখে থাকতে পারি এবং নিজের সত্য প্রকৃতির উপর আস্থা রাখতে পারি| আমরা যেন সত্কর্ম করতে পারি|

‘‘কীটপতঙ্গ জন্মগ্রহণ করে, বংশবৃদ্ধি করে এবং মারা যায়| পশুরাও তাই করে| মানুষও যদি একইভাবে বেঁচে থাকে তবে আমাদের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীদের তফাত্ কোথায়? আমরা পৃথিবীর উদ্দেশ্যে কী বলতে পারি? নিজেদের নিঃস্বার্থ সেবার ফলে মহাত্মাগণ চিরকাল বেঁচে থাকেন| তাঁদের মত অতটা না করতে পারলেও, আমাদের একটু চেষ্টা করা উচিত অন্যদের জন্য আমরা কী করতে পারি| মরুভূমিতে একটি মাত্র গাছ যদি হয় তবে ততটুকু ছায়া পাওয়া যাবে| যদি একটি মাত্র ফুল ফোটে, তা হলে অন্তত ততটুকু সৌন্দর‌্য সৃষ্টি হবে| একটা ‘জিরো পাওয়ারের’ বালবের আলোয় আমরা পড়তে পারব না, কিন্তু যখন এরকম অনেকগুলি বালব একসঙ্গে জ্বলে তখন আমরা ঠিকমত দেখতে পারব| সেইরকম, ঐক্যের সাহায্যে আমরা কতকিছু করতে পারি| পৃথিবী হল একটি হ্রদের মত যা একটি মানুষের পক্ষে পরিষ্কার করা সম্ভব নয়| কিন্তু সবাই যদি নিজের নিজের অংশটি পরিষ্কার করে, তা হলে আমরা একত্রে পৃথিবী পরিষ্কার করতে পারি| আমাদের কুঁড়ে হওয়া উচিত নয়| যা আমাদের সাধ্যের মধ্যে ততটুকু যেন আমরা করতে পারি| এমনি করে আমরা নিশ্চিত ভাবে লক্ষ্য পূর্ণ করতে পারব|

‘‘অন্য যে কোন সিদ্ধান্তের মত সুখও একটি সিদ্ধান্ত – দৃঢ় সিদ্ধান্ত যে ‘যা কিছু হোকনা কেন, আমি সুখী থাকব| আমি শক্তিশালী হব| আমি কখনও একলা নই| পরমাত্মা সর্বদা আমার সঙ্গে আছেন|’ আমার সন্তানেরা যেন প্রয়োজনীয় মানসিক শক্তি সম্পন্ন হয় এবং তারা যেন উত্সাহ ও আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ হয়| ঈশ্বরের কৃপা আমার সব সন্তানদের উপর বর্ষিত হোক|’’